
ভালো কথায় একে বলে ‘দ্বিচারিতা’৷
আর একটু কড়া শব্দে এটাই ‘ভণ্ডামি’৷
সংক্রমণ যে সময়ে রেকর্ড গড়ছে, তখন দেশজুড়ে লক্ষ লক্ষ পরীক্ষার্থীকে JEE-NEET পরীক্ষায় বসতে বাধ্য করলো যে কেন্দ্রীয় সরকার,সেই সরকারই সংক্রমণকে ব্যবহার করে সংসদে বিরোধীদের প্রশ্ন করার অধিকারই কেড়ে নিয়েছে৷
এটাও যদি মোদি সরকারের ভণ্ডামি না হয়, তাহলে ভণ্ডামি’র নতুন অর্থ খুঁজে বার করতে হবে৷
আগামী ১৪ সেপ্টেম্বর শুরু হতে চলেছে সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশন। আর সেই অধিবেশনকে কেন্দ্র করেই কেন্দ্রের ভণ্ডামি চলছে৷ সেই ভণ্ডামির সাফাই, করোনা-সংক্রমণ৷
মহামারি আবহে সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশনে প্রশ্নোত্তর পর্ব থাকলে বেশিসংখ্যক অফিসারকে সংসদে আসতে হবে৷ সেক্ষেত্রে সংক্রমণের আশঙ্কা থাকবে৷ কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর এই ভণ্ডামিকে জাস্টিফাই করে বলেছেন, “এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এ বারের অধিবেশন বসছে। ফলে কিছু নিয়মের এ দিক ওদিক করা হয়েছে।” প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং সাংসদদের জানিয়েছেন, “প্রশ্নোত্তর পর্ব থাকলে, মন্ত্রী যখন প্রশ্নের উত্তর দেন, তখন তাঁর মন্ত্রকের আধিকারিকদেরও সংসদে উপস্থিত থাকতে হয়। এর ফলে সংসদ ভবনে লোকসংখ্যা এক ধাক্কায় অনেক বেড়ে যাবে৷ সংক্রমণ পরিস্থিতিতে এ কাজ করা সম্ভব নয়। তাই প্রশ্নোত্তর পর্ব বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে৷ নিয়ম কিছুটা রদবদল করা হয়েছে”৷ সংসদীয় গণতন্ত্রকে খুন করার পর অবলীলায় এ সব কথা বলেছেন রাজনাথ৷
কেন নিয়মের এ দিক ওদিক করা হয়েছে? বিশেষজ্ঞদের অভিমত, বেশি লোকজন এক জায়গায় থাকলে সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে৷ অধিবেশনের সময় যাতে সংসদে সংক্রমণ না দেখা দেয়, সেজন্যই বাড়তি লোক ঢোকা বন্ধ করা হয়েছে৷ তাই সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশনে এবার প্রশ্নোত্তর পর্ব বাতিল করা হয়েছে, এবং এক ঘণ্টার জিরো আওয়ার-এর সময় ছেঁটে আধ ঘণ্টা করা হয়েছে। এ সবই করা হয়েছে, দেশের সর্বশ্রষ্ঠ VVIP-দের নিরাপদ ও সুস্থ রাখার জন্য৷ এই ‘নিরাপত্তা ব্যবস্থা’ চালু করার মধ্যে হয়তো অন্যায় কিছু নেই, কিন্তু প্রশ্ন আছে৷
JEE-NEET
পরীক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদির কেন্দ্রীয় সরকার তাহলে কেন অহেতুক জেদ দেখালো ? পরীক্ষার্থীদের ৯৫ ভাগই যেহেতু সাধারণ পরিবারের সন্তান এবং VIP নন, তাই তারা ভাইরাসের শিকার হলে বা আরও খারাপ কিছু হলে, রাষ্ট্রনেতাদের কিছু আসে যায়না৷ আজ সংসদের নিরাপত্তার যে কারনে বৃদ্ধি ঘটানো হয়েছে, সেই একই কারন তো পরীক্ষার্থীদের জন্যও প্রযোজ্য হতে পারতো৷ অহেতুক জেদ কেন দেখানো হলো ? আজ রাজনাথ সিং, রবিশঙ্কর প্রসাদরা নিজেদের স্বার্থে মুখ খুলেছেন, অথচ পরীক্ষার্থীদের বেলায় ছিলেন মুখ বন্ধ করেই৷ এই দ্বিচারিতা সাধারণ মানুষ ধরে ফেলেছেন৷
আসলে প্রতিপদেই ব্যর্থ মোদি সরকার ব্যর্থতা ঢাকতে এবং রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে মহামারি সংকটকে ব্যবহার করে চলেছে৷
করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে চরম ব্যর্থ হয়েছেন মোদি৷ তার মধ্যেই GDP তলানিতে৷ সীমান্তে যুদ্ধের একটা আবহ যেন তৈরি করা হচ্ছে৷ কেন্দ্রের লাগামহীন ব্যর্থতা নিয়ে বিরোধীদের আক্রমণ চলছেই। প্রধানমন্ত্রী গত ৭ বছর ধরে শুধুই বলেছেন৷ কোনও বিরূপ প্রশ্নের মুখে দাঁড়ানোর মনোবল তাঁর নেই৷ ফলে, করোনা সংক্রমণকে ব্যবহার করা ছাড়া গতি নেই৷ প্রশ্ন ‘ফেস’ করতে আতঙ্কিত কেন্দ্র তাই মহামারিকে ব্যবহার করেই সংসদে বাদল অধিবেশনে কাঁচি চালিয়েছেন প্রশ্নোত্তর-পর্বে৷ সরকারকে প্রশ্ন করার যে সুযোগ বিরোধীরা পান, তা কেড়ে নেওয়া হয়েছে৷ কারন, সংসদে দাঁড়িয়ে অসত্য বলা যায়না৷ আর যে কোনও প্রশ্নের উত্তরে সত্যি কথা বললে, সরকারকে উলঙ্গ করবেন শাসকরাই৷ এই পরিস্থিতি এড়াতেই করোনাকে ব্যবহার করেছে বিজেপি সরকার৷ বিরোধীরা তাই যথার্থভাবেই বলছেন, মহামারিকে অজুহাত বানিয়ে গণতন্ত্রকে হত্যা করছে মোদি সরকার৷ বিরোধীদের কাছ থেকে সরকারকে প্রশ্ন করার অধিকারই কেড়ে নেওয়া হল।
প্রশ্ন উঠেছে, বাস্তব পরিস্থিতি উপেক্ষা করে কেন্দ্র যখন নিজেই সবকিছু স্বাভাবিক প্রতিপন্ন করার মরিয়া চেষ্টায় নেমেছে, JEE- NEET নিয়ে যখন জেদ দেখাতে পারছে সংক্রমণ ভুলে, সংসদের কাজকর্মের সময়সীমাও যখন আগের মতোই রয়েছে, তাহলে মহামারির অজুহাতে শুধুমাত্র প্রশ্নোত্তর পর্বই বাতিল করা হল কেন?
এর উত্তর, প্রশ্নের মুখে দাঁড়াতে হলে সরকারের জামাকাপড় এবার হলুদ হওয়ার সম্ভাবনা পুরোমাত্রায়৷ তাই ভয় পাচ্ছেন মোদি৷ ফলে, তুলে দেওয়া হয়েছে প্রশ্নোত্তর পর্ব৷ একেবারে ঢাকি-সহ বিসর্জন৷ রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলে, সরকারকে প্রশ্ন করার বিরোধীদের অধিকার সংসদীয় গণতন্ত্রকে মজবুত করে। কিন্তু পড়াশুনো কম থাকার কারনে এসব কথা হয়তো বিজেপির কোনও নেতা কখনই শোনেননি৷
সর্বস্তরে নিদারুণ ব্যর্থতা, অদক্ষতা, অযোগ্যতা ঢাকতে আজ নরেন্দ্র মোদির একমাত্র হাতিয়ার “করোনাভাইরাস”৷ নরেন্দ্র মোদি সরকারের সাম্প্রতিক কৌশল, দৈনন্দিন সঙ্কটের মোকাবিলা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখা, পালিয়ে থাকা৷ দূরে সরিয়ে রাখার এই ছক নরেন্দ্র মোদি শিখেছেন বন্ধু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছ থেকে৷ আর সেই কাজে সংক্রমণের ভয়কে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করার ঢালাও চেষ্টা চলছে৷
বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের অস্তিত্ব, গরিমা, ভাবমূর্তি ক্রমশ
তলানিতে ঠেকছে৷
তাই আজ বেকায়দায় পড়ার আশঙ্কা দেখলেই সাম্প্রতিক বিপর্যয়কে কাজে লাগাচ্ছে৷ তারই একটা অংশ, সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশনে প্রশ্নোত্তর পর্ব বাতিল, জিরো আওয়ারের সময় হ্রাস৷
কেন্দ্র আজ প্রতি পদেই মুখাগ্নিকে সন্ধ্যারতি ভাবছে৷ এই ভাবনায় চালিত হয়ে কিন্তু কেউ কখনও রক্ষা পায়নি৷