রাশভারী মন্ত্রী নন, শ্যামলকাকু ছিলেন স্নেহশীল বন্ধুর বাবা-পাড়ার কাকুর মতো

জয়িতা মৌলিক

0
2

স্কুলবাস মিস করেছি, আবাসনের এক গেট থেকে অন্য গেটে ছুটছি পাবলিক বাসে স্কুল যাব বলে- সেই সময় সেই গেট দিয়ে বের হচ্ছেন তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের ডাকসাইটে মন্ত্রী। গাড়ি থামিয়ে জানলা দিয়ে মুখ বের করে বললেন, ” ছুটছিস কেন? পড়ে যাবি তো। বাস মিস করেছিস? উঠে আয়”। জানি তিনি যাবেন মহাকরণ আর আমি যাব হেদুয়া। তবু গাড়ি ঘুরিয়ে বিধানসরণির মুখে নামানোর সময় তাঁর গলায় কুণ্ঠা। “এটুকু হেঁটে যেতে পারবি তো? ওয়ানওয়ে, না হলে অনেকটা ঘুরতে হত।” সম্মতি সূচক মাথা নেড়ে গাড়ি থেকে নেবে আবার ছুটে স্কুল। বাসের আগে আমি স্কুলে পৌঁছেছিলাম সেদিন। কিন্তু সেই বয়সে একেবারে বুঝিনি কতটা প্রিভিলেজ পেলাম। কারণ তিনি বুঝতে দেননি। একবারও মনে হয়নি যিনি নিজের দফতরে যাওয়ার পথে গাড়ি ঘুরিয়ে আমাকে স্কুলের কাছে নামালেন তিনি আমার বন্ধু তথা বোন বুয়া অর্থাৎ ঊষসী চক্রবর্তীর বাবা ছাড়া অন্য কেউ। এটাই বিশেষত্ব ছিল দাপুটে সিপিআইএম নেতা তথা সেই সময় রাজ্য সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী শ্যামল চক্রবর্তীর। আবাসনে তিনি থাকতেন একেবারে আর পাঁচটা পাড়ার লোকের মতো। আমাদের সঙ্গে ব্যবহার করতেন পাড়ার স্নেহশীল কাকু, বন্ধুর বাবার মতোই। যেহেতু তাঁর মেয়ে আমার থেকে কয়েক বছরের জুনিয়র, তাই আমাকেও মাঝে মাঝে কাকু ‘জয়িতা দি’ বলেই ডাকতেন।

সেদিনকার কথা এখনও মনে পড়ে, যেদিন আমার মা চলে গেলেন। সেদিন স্কুলে গিয়ে প্রধানশিক্ষিকাকে কাকু বলেছিলেন, “ঊষসীকে আজ তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিন, ওর জেঠিমা মারা গেছেন”। তারপর বুয়া স্কুল থেকে নিয়ে সোজা আমার পাশে এনে বসিয়ে দিয়েছিলেন। কাকু বুঝেছিলেন, কৈশোরের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে মাতৃহারা একটি মেয়ের তখন বন্ধুকেই প্রয়োজন হবে সবচেয়ে বেশি।
তারপরে আরও অনেক অনেক স্মৃতি। বৃহস্পতিবার, শ্যামলকাকুর চলে যাওয়ার খবর পাওয়ার পর থেকে সব স্মৃতি ভিড় করে আসছে।
সেবার আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় আমি আর বুয়া দুজনেই আলাদা আলাদা বিভাগে জেলা থেকে প্রথম হয় রাজ্য স্তরের প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছি সেটা হচ্ছে বহরমপুরে। ট্রেনে দুজনের বাবা চলেছেন সঙ্গে। ফেরার সময় বিপত্তি- পরেরদিন কাকুর গুরুত্বপূর্ণ মিটিং, আমার বাবারও খুব সম্ভব স্কুলে কোনও গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার সিট। সুতরাং পরেরদিন ট্রেনে ফেরার অবকাশ নেই। অগত্যা কাকুর গাড়িতেই ঠাসাঠাসি করে সবাই উঠে পড়লাম। পরে বাবা বলেন, মাঝ রাস্তায় হঠাৎ তিনি দেখেন গাড়ির পেছনটা নিস্তব্ধ। দেখা যায় পেছনের সিটে আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে বুয়া এবং আমি যথারীতি কাকুর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছি। বাবা আমাকে ডাকতে গেলে, কাকু বারণ করে বলেন, “ঘুমোচ্ছে ঘুমোক। জাগলেই দুজনে আবার গল্প শুরু করবে”। এভাবেই কেটেছে শৈশব। একবার কোনো একটা সরকারি চাকরির পরীক্ষা বা ভর্তির কারণে ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট নিতে গিয়েছি কাকুর কাছে। দেখে ফিক করে হেসে বললেন, “তোকে দেব ক্যারেকটার সার্টিফিকেট!” সেক্রেটারি লিখলেন, “গত পাঁচ বছর ধরে মন্ত্রী মশাই আমায় চেনেন”। কাকু মৃদু ধমক দিয়ে বললেন, “লিখে দাও ওর পাঁচ বছর বয়স থেকে চিনি”। সেই চেনাটা কোনদিন ভোলেননি। আবাসন ছেড়ে চলে গিয়েছেন বাইপাসের ধারে অন্য একটি আবাসনে। অসুস্থ হলে সেখানে একবার দেখা করতে গিয়েছিলাম। তারপরে কালের স্রোতে আমিও পাড়া-ছাড়া। বেশ কয়েক বছর আবার যখন ফিরে এসেছি, তখন পুজোয় দেখা হলে সবার সামনে আবার সেই পরিচিত ডাক, ” জয়িতা দি কেমন আছিস? বাবা কেমন আছেন?” রাজনীতি ক্ষেত্রে বাবার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল ভালোই। কিন্তু সেই রাজনীতির পরিচয় কোনদিন আমাদের মধ্যে প্রভাব ফেলেনি। আর যারা বুয়ার পাড়ার বন্ধু ছিল, তাদের সঙ্গে সব সময় বন্ধুর বাবার মতোই মিশেছেন শ্যামল চক্রবর্তী। তাই তাঁর চলে যাওয়া রাজনৈতিক জগতের ক্ষতি থেকেও আমার কাছে স্বজন হারানোর বেদনা।