থমকেছে বেঙ্গালুরু: পরিযায়ীদের নিয়ে সদর্থক ভূমিকা প্রয়োজন

তোর্সা মুখোপাধ্যায়, বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা

0
1

দীর্ঘ আঠেরো বছরের প্রবাস জীবনে বেঙ্গালুরু শহরে থমকে যাওয়ার অভিজ্ঞতা প্রায় নেই বললেই চলে। কন্যার বার্ষিক পরীক্ষা মাঝপথে স্থগিত হল, পুত্রের স্কুল এবং কর্তার অফিস ক্রমান্বয়ে। বাড়ির সাহায্যকারীর উপস্থিতি নিষিদ্ধ হল। লকডাউনের প্রথম পর্যায়ে এ যাবৎ কাটিয়ে আসা জীবন থেকে এটুকুই আলাদা ছিল মাত্র। রাস্তাঘাট জনহীন, কর্কশ শব্দহীন। চাল-ডাল ইত্যাদি যেহেতু মাস খানেকের মত সর্বদাই মজুত থাকে তাই সেদিকেও তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। অভিনবত্ব অন্যত্র। আমরা বাড়ির চার সদস্য অষ্টপ্রহর নিরবিচ্ছিন্নভাবে একসঙ্গে, মুখ তুললেই মুখোমুখি। ধর্মক্ষেত্র, মানে যাকে বলে সংসার আর কর্মক্ষেত্রের চাপানউতোর, টানাপোড়েন চারিয়ে গিয়েছে ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যেও। তবে একথা মানতেই হবে যে কখনওই মনে হয়নি যে সাংঘাতিক অসুবিধার মধ্যে আছি।

অনেক বেশি আতঙ্কের আঁচ পেয়েছি পরিযায়ী শ্রমিকদের নিষ্ক্রমণ নিয়ে। ওদের বর্তমান টালমাটাল পরিস্থিতি আশা করি প্রশাসনকে কোনও সদর্থক পদক্ষেপের দিকে ভাবতে বাধ্য করবে। এঁদের গতিবিধির নথিবদ্ধকরণ আশু প্রয়োজন। ঠিক যেমন আমরা অন্য দেশে বেড়াতে গেলে কোথায় থাকব, কী করব সব লিখতে হয় তেমনই। আমার দেশে তো অনেক অনেক মানুষ। তাই হয়তো প্রশাসন সেই সংখ্যাধিক্যের অজুহাতে এই অনেক অনেক মানুষকে শুধুমাত্র ভোটার ছাড়া আর কিছু ভাবতে চান না। প্রায় একই দশা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ও।
জব সিকিউরিটি বলে কোন কিছুর অস্তিত্বই নেই। ঠিক যুদ্ধের সময় যেমন হয়। স্থানীয় সরকার প্রতিদিন প্রায় নতুন নতুন নির্দেশাবলী প্রকাশ করছেন। প্রাথমিক এবং প্রাক প্রাথমিক পর্যায়ে লাইভ অথবা রেকর্ডেড ক্লাস হবে কি হবে না তাই নিয়ে চলছে স্কুল কর্তৃপক্ষ, ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবক কুল, মনস্তত্ত্ববিদ এবং সরকারের বিস্তর আলোচনা এবং পর্যালোচনা।একশ্রেণীর বাবা মায়েরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।
আবার বাড়ি থেকে কাজ করা মানে তো বাড়ি এবং কর্মক্ষেত্রে দুটোকে একসঙ্গে সামাল দেওয়া। তাও কতদিন চলবে কেউ জানে না। বিশেষত মহিলাদের দশভূজা বা বিশভূজা হয়ে চলতে হচ্ছে, উপায় নেই। চুল কাটা, গোঁফ ছাঁটা থেকে বাথরুম পরিষ্কার কিচ্ছু বাদ নেই। ব্যতিক্রমও বিস্তর। এই সুযোগে কিছু মানুষ ঘোলা জলে মাছ ধরছেন। ঠিক যেমনটি হওয়ার কথা ছিল। সামর্থ্য এবং যোগান থাকা সত্ত্বেও কিছু অভিভাবক স্কুলের বেতন দিতে নারাজ, স্কুল কর্তৃপক্ষ তার বেতনভোগী কর্মচারীদের (পড়ুন শিক্ষক-শিক্ষিকা) বাধ্য করছেন ত্রাণ তহবিলে দান (?) করার অছিলায় বেতন কম নিতে। ভেন্ডার এর নাম পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে সহজ কিস্তিতে কম্পিউটার কেনার জন্য। আমরা কি সত্যিই এতোটাই ডিজিটাল হয়েছি?
স্বাবলম্বী হওয়াটা অত্যন্ত জরুরি হলেও, উপযুক্ত যান্ত্রিক পরিকাঠামো ছাড়া পশ্চিমের মত সব কাজ নিজে করে ফেলা যাবে সেটা ভাবার সময় এসেছে কি না সে চিন্তা করা আগে করা দরকার। আর এই পরিকল্পনা নিয়ে বাড়ির সাহায্যকারী কে অনির্দ্দিষ্টকালের জন্য আসতে বারণ করে দেওয়া খানিকটা অমানবিকতার পরিচয় হয় বৈকি। জনবহুল দেশে তাদেরও তো অন্নসংস্থানের প্রয়োজন আছে। প্রয়োজনমতো ভুলে যাওয়া ঠিক নয় যে এদেশটা আমেরিকা নয়।