সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে, এছাড়া থিয়েটারকে বাঁচানোর কোনও পথ নেই

0
1
প্রান্তিক চৌধুরী, নাট্যব্যক্তিত্ব

“জানি ছেড়ে যেতে হবে,
তাও বড্ড মায়া”- এমনিতেই মন বেশ ভারী হয়ে রয়েছে। ঠিক ধরেছেন, সুশান্তের মৃত্যুর জন্য। না, ওঁর কাজ আর কোনোদিন দেখতে পাবো না বলে শুধু নয়, তাঁর এই সমস্ত দায়দায়িত্ব ছেড়ে, জীবনের সমস্ত সমস্যাগুলিকে ছেড়ে, তাঁর উপর নির্ভরশীল তাঁর প্রিয় মানুষগুলিকে ছেড়ে পালিয়ে যাওয়াটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে খুব। না, আমার হিরোরা হেরো হতে পারে না।

যাকগে, আসল প্রসঙ্গে আসি। ‘এখন বিশ্ব বাংলা সংবাদ’ থেকে জয়িতা জানতে চাইলেন করোনা পরবর্তী সময় থিয়েটারের ভবিষ্যত আমি একজন থিয়েটারজীবী হিসেবে কী মনে করি, যেখানে টলিউডে শুটিং শুরু হয়ে গিয়েছে?
হ্যাঁ, আমি একজন থিয়েটারজীবী। অন্য কোনো রকম পেশার সাথে গত তিন বছর ধরে আমি যুক্ত নই। লকডাউন আমার জীবনকেও একটা বড় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। কারণ থিয়েটারের সঙ্গে আমার দুটি ভিন্ন রূপে যোগ আছে। আমি যেমন একজন ফ্রিলান্স অভিনেতা, নির্দেশক, পোশাক পরিকল্পক, তেমনই আমি একজন থিয়েটার প্রযোজকও বটে। অর্থাৎ আমি যেমন আর বিশটা দলের প্রযোজকদের উপর আর্থিক কারণে নির্ভরশীল তেমনই আমার এবং আমার দল ব্যারাকপুর ব্রাত্যজনের (আমি যাকে কোম্পানি বলি) উপরেও বেশ কিছু মানুষ আর্থিক ভাবে নির্ভরশীল। ফলে আমার মনে করোনা পরবর্তী সময়ে থিয়েটারের ভবিষ্যত নিয়ে কিছু দোনামনা আছে।

যেমন ধরুন, একটি বিষয় নিয়ে খুব হইচই চলছে যে হলগুলি কবে খুলবে? আমি একজন ফ্রিলান্সার হিসেবে চাই এখুনি হলগুলি খুলে যাক। যে চার-পাঁচটি চলতি প্রয়োজনাতে আমি ফ্রিলান্সার হিসেবে অভিনয় করতাম সেগুলির আবার শো হোক। আমার ফ্রিলান্স-নির্দেশক হিসেবে সদ্যমুক্তিপ্রাপ্ত নাট্য “দেবদাস”-এর শো আবার শুরু হোক (যার মুক্তি পাওয়ার দু’মাস দশ দিনে দশটি শো হয়েছিল, যার মধ্যে ছ’টিই আমন্ত্রিত। আরো দু’টি আমন্ত্রিত শো হাতে ছিল যা লকডাউনের জন্য করা যায়নি। ফলে প্রযোজক খুশিই ছিলেন। তার সাথে চুক্তি অনুসারে প্রতি পঁচিশটি শো-এর পর আমার ইনসেনটিভ পাওয়ার কথা। আমি প্রথম ধাপের খুব কাছাকাছি ছিলাম)। কারণ ফ্রিলান্সার হিসেবে শো-ই আমার আয় করবার প্রধান পথ।
আবার প্রযোজক হিসেবে আমার মনে হয়, হল খুললে সরকার যে ক’জন দর্শক অনুমোদন করবে তাতে শো করে টাকা তুলতে পারব তো? দর্শক আসবেন তো? ফেস্টিভালগুলি হবে তো? এই বিষয়গুলি আমাকে খুব ভয় পাওয়ায়।

কিন্তু না। আমি ভয় পেলেও পালাবার মানুষ নই। আমার মনে হয় বাকি সমস্ত বিষয়ের মতো সরকার আমাদের দিকেও নজর দেবেন। অন্য পেশাগুলির মতোই আমাদের পেশাকেও গুরুত্ব দেবেন। কিছু প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করে হল খোলার নির্দেশও দেবেন খুব তাড়াতাড়ি। আসলে আমার মনে হয় শুটিংসহ অন্য কাজগুলি যতটা ডিস্টেনসিং মেনে করা সম্ভব থিয়েটারে তাও সম্ভব নয়। তাই হয়তো সরকার পরিস্থিতি আর একটু সামলে হল খুলতে চাইছেন। আশাকরি সরকার আমাদের কথা ভুলে যাবে না। ভুললে আমরা মনে করাতেও জানি(উইঙ্কেল-টুইঙ্কল,পশু খামার এবং রুদ্ধ সঙ্গীত এই তিনটি নাট্য কিন্তু একটা সরকারের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল)।
তবে হল খুললেও আমাদের কিছু বিকল্প পথের সন্ধান করতেই হবে। থিয়েটারকে নিয়ে যেতে হবে মানুষের একদম অন্দরমহলে। তার জন্য খুঁজে ফেলতে হবে এমন কিছু পথ যাতে থিয়েটারের নিজস্বতা বজায় রেখে খুব কম খরচে তাকে মানুষের কাছে পৌছে দেওয়া যায়। মঞ্চ থিয়েটারের খরচও কমিয়ে ফেলতে হবে। এবং তার জন্য সমস্ত থিয়েটারজীবীদের একসাথে বসে ন্যূনতম চাহিদা নির্ধারণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া থিয়েটারকে বাঁচানোর কোনও পথ নেই। সবার এখন পেটে গামছা বেঁধে লড়াই করার সময় এসেছে। সবাইকে একটি থিয়েটারের “অংশীদার” হতে হবে। আর যাঁরা তা হতে চাইবেন না তাঁদের থিয়েটার ছেড়ে অন্য কাজে যুক্ত হওয়াই ভালো।
প্রযোজকদেরও কিছু বাড়তি দায়িত্ব নিতে হবে। ন্যূনতম প্রযোজনা খরচ জোগাড় তাঁকেই করতে হবে। যেভাবেই হোক কাজটিকে বিক্রয়যোগ্য করে তুলতে হবে, যাতে এই কাজের সাথে যুক্ত প্রত্যেক মানুষের চাহিদা পূরণ হয়। যাঁদের নেই তাঁদের স্বাস্থ্যবিমার ব্যবস্থা করে ফেলতে হবে।
প্রসঙ্গত বলে রাখি আমার দল ব্যারাকপুর ব্রাত্যজন থিয়েটারজীবীদের জন্য স্বাস্থ্যবিমার উদ্যোগ নিয়েছে। প্রয়োজন হলে বা এই উদ্যোগে যুক্ত হতে চাইলে যোগাযোগ করতে পারেন ব্যারাকপুর ব্রাত্যজনের ফেসবুক পেজে।
আর দায়িত্ব নিতে হবে অন্য পেশার সাথে যুক্ত আছেন তবু থিয়েটারও করেন এমন মানুষদের। আপনারা কিছুটা হলেও ভালো অবস্থায় আছেন বলেই এই সঙ্কটকালে বাড়তি দায়িত্ব নিতে হবে। আর এগিয়ে আনতে হবে থিয়েটার- প্রিয় উচ্চবর্গের মানুষদের। যাঁরা একটু এই গাছটার গোড়ায় অর্থের জোগান দিতে পারবেন।
আমি বিশ্বাস করি থিয়েটার কোনদিন শেষ হওয়ার নয়। যে শিল্প সরাসরি মানুষের চোখের সামনে হয়, তার মৃত্যু নেই। তা আজীবন জীবিত।
আমি এবং ব্যারাকপুর ব্রাত্যজন ফেরত আসব অনেক নতুন ভাবনা নিয়ে। সঙ্গে থাকবেন সবাই।
শেষে, শুরুর গানটির আরো দুটো লাইন রইলো আপনাদের জন্য…
“পিছুটানে এ শহর,
তাও বেহায়া।”
(লাইন দুটি ব্যারাকপুর ব্রাত্যজনের “দ্বিধা” নাট্যের শীর্ষসঙ্গীতের। কথা লিখেছেন সুদীপ সিংহ)