‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ করে কাজ শুরু টলিপাড়ায়, তাড়াহুড়োর বড় মাশুল গুনতে হবে না তো? রূপাঞ্জনা মিত্রর কলম

0
1

ইংরেজরা ভারত ছেড়ে চলে গিয়েছে অনেক বছর। কিন্তু তাদের শেখানো অনেক জিনিসই এখনও আমরা বয়ে বেড়াচ্ছি। শুধু ‘থ্যাংক ইউ’ বা ‘সরি’-র কথা বলছি না, বলছি তাদের নীতির কথা- “ডিভাইড অ্যান্ড রুল”। সব সময় যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন, তাঁরা প্রতিবাদীদের মধ্যে ভাগ করে প্রতিবাদ দমনের চেষ্টা চালান। কথাটা আরও বেশি মনে হচ্ছে টলিপাড়ায় সাত তাড়াতাড়ি শ্যুটিং শুরু হওয়ায়। ৮৪ দিন পরে শুটিংয়ে যাঁরা ফিরেছেন, তাঁরা অনেকেই হয়তো ভাবছেন এটাকে আমি সাত তাড়াতাড়ি বলছি কেন? বলছি তার কারণ এখনও করোনা পরিস্থিতি যথেষ্ট সঙ্গিন। কিছু কিছু মানুষ অজ্ঞতার বসে অথবা না জেনে হয়তো মাস্ক পরছেন না। তবে বেশিরভাগ লোকই সব সময় মাস্ক, গ্লাভস এসব পড়ছেন। কিন্তু আমরা যাঁরা অভিনয় করি- আমাদের সে সুযোগ নেই। এই অবস্থায় হঠাৎ করে কাজ শুরু হল।

ভালো খবর। কাজে ফেরাটা তো নিশ্চয়ই জরুরি; বিশেষ করে আমাদের মত পেশায়। কারণ এখানে অনেকেই আছেন যাঁরা দৈনিক মজুরিতে কাজ করেন। সেখানে কাজ শুরু নিশ্চয়ই একটা উল্লেখযোগ্য বিষয়। কিন্তু শুধু আশ্বাসের ভিত্তিতে এটা হওয়া কি খুব জরুরি ছিল? স্বাস্থ্যবিমা কার্ড বা বন্ড হাতে চলে আসার পর এই কাজ শুরু করা যেত না? এতদিন যেখানে দেরি হল, সেখানে আর কটা দিন দেরি হলে কী হত?
যাঁরা এই প্রশ্ন তুলেছিলেন, তাদেরকে ভাগ করে দেওয়া হল। কারা ভাগ করলেন? যাঁরা স্টুডিওপাড়ায় ক্ষমতা দখল করে থাকতে চান। সবাই সহানুভূতিশীল- চ্যানেল কর্তারা, প্রযোজকরা, অভিনেতা-অভিনেত্রী, কলাকুশলীদের সংগঠন। কিন্তু প্রত্যেককে আলাদা আলাদা ভাবে বোঝানো হল। যখন তাঁরা একজোট হয়ে কাজে না নামার সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন তাদের ইউনিটিকে ভাঙার চেষ্টা হল। কেউ কেউ রাজি হলেন, কেউ কেউ নিমরাজি হলেন, আবার কেউ কেউ কী আর করা যাবে- এই ভেবে শুটিং ফ্লোরে ফিরলেন। কিন্তু সত্যিই দায়িত্ব নেবে কে? যেখানে এখনও কম পারিশ্রমিক পাওয়া অভিনেতা-অভিনেত্রীদের থেকে টাকা কেটে নেয় সংগঠন। তাঁদের পারিশ্রমিকের চেক আসার পরেও সেটা আটকে রাখা হয়। সেখানে সত্যি কতটা সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ? সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখলাম একজন শাসকদল ঘনিষ্ঠ প্রযোজক বলছেন, “এরপরে দর্শকরা চাইলে তাঁদের জন্যেও তাহলে বিমা করে দিতে হবে”- এই যদি মনোভাব হয়, তাহলে শুটিং ফ্লোরে নিরাপত্তা কতটা থাকছে?

একটা কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি আমরা। অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। এমন একটা ভাইরাস যেটাকে বধ করার জন্য বিশ্বের তাবড় বিজ্ঞানীরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এখনও কোন ভ্যাকসিন বা ওষুধ বেরোয়নি। এই পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিমা ছাড়া শুটিং শুরু করা খুব যুক্তিযুক্ত কি? যেখানে কোনরকম সুরক্ষা না নিয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে হচ্ছে আমাদের। এটা রাজনীতির সময় নয়, আমি রাজনীতির কথা বলছি না। কিন্তু নিজের অধিকারটা তো বুঝে নিতে হবে। নিজের অধিকার বুঝে নেওয়া বা তার জন্য আওয়াজ তোলার মধ্যে কোনও অন্যায় নেই। আর প্রশ্ন যখন জীবনের, তখন এই দাবিটা তো খুব অপ্রাসঙ্গিক নয়। হয়তো বিমার কাগজ হাতে চলে এলে বিষয়টা অনেক সহজ হয়ে যাবে। তখন হয়তো নিশ্চিন্তে কাজ করা যাবে। কিন্তু এই যে ঐক্যবদ্ধভাবে একটা দাবির তুললেই সেটা আটকানোর চেষ্টা- এই প্রক্রিয়াটায় আমার আপত্তি আছে। এটা মনে করিয়ে দেয় ইংরেজ আমলে ‘ডিভাইডেড অ্যান্ড রুল পলিসি’কে। সবাইকে আলাদা আলাদা করে বোঝাও- একজনকে বলো নিজের অধিকার বুঝে নিতে, আরেকজনকে বলো সুবিধামতো অধিকার দিতে। এতে সাপও মরল লাঠিও ভাঙল না। কিন্তু দিনের শেষে লাভটা কার হল? বিপদের মুখে পড়ল করা? সে কথাটা কী কেউ ভেবে দেখছে?
অনেকে হয়তো এটা পড়ে ভাববেন আমি কাজ শুরুর বিরোধিতা করছি। একেবারেই নয়। কাজে ফিরতেই হবে। শুধু টাকার জন্য নয়, আমার মতো অনেকেই তীব্র প্যাশন থেকে এই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যুক্ত। শুধু লোককে বিনোদন দেওয়া নয়, এ জগতে আমরা নিজেরাও আনন্দে থাকি। সুতরাং কাজ বন্ধ করে বাড়িতে বসে থাকার পক্ষপাতী আমি একেবারেই নই। কিন্তু জীবন থাকলে তবেই তো জীবিকা। কাজটা তো সুরক্ষিতভাবে করতে হবে। তাড়াহুড়ো করে কোনরকমে বুঝিয়ে-সুজিয়ে, যা হয় দেখা যাবে পাশে আছি- গোছের আশ্বাস দিয়ে কাজ শুরু হল। তারপর ভালো-মন্দ কিছু হলে দায়িত্ব নেওয়ার লোক পাওয়া যাবে তো? কারণ পূর্ব অভিজ্ঞতা বলছে, অর্ধেক সময় পাওয়া যায় না। এর আগেও বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আমরা একজোট হয়ে লড়াই করেছি। বারবার সেই একই ভাবে “হয়ে যাবে, আগে কাজ শুরু হোক” বলে বিষয়টা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে করোনাভাইরাস কিন্তু ধামাচাপা দেওয়া যায় না। এই ভুল যদি কেউ করেন তাহলে তার খুব বড় মাশুল গুনতে হবে। কাজ চলুক, ভালোভাবে চলুক, সবাই নিরাপদে কাজ করুন। নিজেদের সুরক্ষার দিকটা দেখুন। আর একটা কথা মাথায় রাখুন, নিরাপদে সুরক্ষিত ভাবে কাজ করাটা কিন্তু আমাদের অধিকার। নিজের অধিকারকে ভুলে যাবেন না।