চিকিৎসকদের দায় কেন্দ্রের নয়, খুলে গেলো মুখোশ, কণাদ দাশগুপ্তর কলম

0
3
কণাদ দাশগুপ্ত

পরিশীলিত ভাষায় বলা যায় এটা ‘দ্বিচারিতা’৷

একটু কঠিন ভাষায় এটা কেন্দ্রীয় সরকারের ‘ভণ্ডামি’৷

ঢাক-ঢোল পিটিয়ে প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে বলেছিলেন, ‘প্রথম সারির করোনা যোদ্ধাদের’ অভিনন্দন,কৃতজ্ঞতা জানাতে থালা-বাটি বাজান!

পরের ধাপে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, এবার হ্যারিকেন হাতে নিন৷

আপাতত শেষ বারের মতো ওই ‘প্রথম সারির করোনা যোদ্ধাদের’ অভিনন্দন জানাতে বহু কোটি টাকা খরচ করে হাসপাতালের মাথায় আকাশ থেকে ফুল ফেলার ঘোষণা করেছেন নরেন্দ্র মোদি৷

গোটা দেশ বাহবা দিয়েছে মোদিজিকে৷ সত্যি, এই করোনা-আগ্রাসনের সময় প্রধানমন্ত্রী কতখানি উদ্বিগ্ন দেশের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য৷ ভক্তরা সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলে প্রধানমন্ত্রীকে ঈশ্বরের পাশের চেয়ারেই বসিয়ে দেয়৷

এবার বোঝা গেলো, করোনার ভয়াবহতা সামলাতে নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে সবটাই ছিলো প্রধানমন্ত্রীর Scripted Acting, পরামর্শদাতাদের তৈরি করা চিত্রনাট্য অনুসারে অভিনয় করেছেন তিনি৷ চিরকালই ভালো অভিনেতা তিনি, ঠিকঠাকই উৎরে দিয়েছেন চিত্রনাট্য ৷

এবার মুখ আর মাস্ক আলাদা হয়ে গেলো৷ স্পষ্ট হলো কেন্দ্রের দ্বিচারিতা৷

সুপ্রিম কোর্টে বৃহস্পতিবার হলফনামার মাধ্যমে
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক শীর্ষ আদালতকে জানিয়েছে, “চিকিৎসক, নার্স ও চিকিৎসাকর্মীরা করোনাভাইরাস সংক্রমণের হাত থেকে কী ভাবে নিজেদের রক্ষা করবেন, তার দায়িত্ব তাঁদেরই নিতে হবে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কিছুই করার নেই৷”
মুখ থেকে সরে গেলো চিকিৎসক-প্রেমীর মুখোশ৷ সামনে চলে এলো, দায় এড়াতে সিদ্ধহস্ত সেই
অমানবিক মুখটাই৷

শুক্রবার সকালে দেওয়া
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের
পরিসংখ্যান বলছে, দেশে নতুনভাবে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ৯৮৫১ জন৷ গত ২৪ ঘন্টায় মৃত্যু হয়েছে ২৭৩ জনের৷
গোটা দেশে মোট করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ২,২৬,৭৭০ জন৷ মোট মৃতের সংখ্যা ৬,৩৪৮ জন৷
এই পরিসংখ্যান প্রমান করছে, গত মার্চ থেকে চেষ্টা চালিয়েও কেন্দ্র ন্যূনতম নিয়ন্ত্রণ আনতেও ব্যর্থ হচ্ছে৷ এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে দেশবাসীর একমাত্র ভরসার স্থল কেন্দ্রীয় সরকার নয়, চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা৷ সেই চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের সুস্থ রাখার দায়টাও ঝেড়ে ফেললেন প্রধানমন্ত্রী৷

গোটা দেশে এ পর্যন্ত কয়েক হাজার চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্তদের সুস্থ করার কর্তব্য পালন করতে গিয়ে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন৷ মৃত্যু -সংখ্যাও কম নয়৷ শুধুমাত্র দিল্লি AIIMS- এ এখনও পর্যন্ত
চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মী মিলিয়ে করোনা-আক্রান্ত ৪৮০ জন৷ বেশ কয়েকজনের মৃত্যুও হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ -সহ দেশের অন্য রাজ্যগুলির ছবিও এক৷

ঠিক সেই পরিস্থিতিতে
সুপ্রিম কোর্টে পেশ করা হলফনামায় স্বাস্থ্যমন্ত্রক বলেছে, “সংক্রমণ কী ভাবে প্রতিহত করতে হবে তার চূড়ান্ত দায়িত্ব চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদেরই৷ চিকিৎসার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর্মীরাই সামনে থাকেন, ফলে তাঁদের সংক্রমণের আশঙ্কাও থাকে৷ নিজেকে যথাযথভাবে প্রশিক্ষিত করে তোলা তাঁদেরই কর্তব্য৷’
এখানেই শেষ নয়, মোদি সরকারের আরও বক্তব্য, “সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত যাবতীয় দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের৷ তাই চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের সংক্রমণ প্রতিহত করার চূড়ান্ত দায়িত্ব নিজেদেরই৷”

করোনা যুদ্ধে চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে, নিরাপত্তা নিয়ে উদয়পুরের আরুশি জৈন নামে এক চিকিৎসক সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা করেছেন৷ সেই মামলাতেই নিজেদের এই নীতি, দৃষ্টিভঙ্গি, কর্তব্য এবং দায়িত্ববোধের কথা
হলফনামার মাধ্যমে জানিয়েছে নরেন্দ্র মোদি সরকার৷ কেন্দ্রের এই মানসিকতা ও পলিসি সামনে আসতেই সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন উঠছে, প্রথমদিন থেকে প্রধানমন্ত্রী যাঁদের “প্রথম সারির করোনা যোদ্ধা” বলে তথাকথিত কৃতজ্ঞতা জানালেন, তাঁদের সুস্থ রাখার দায়িত্ব সরকার নিচ্ছে না কেন? দেশে এই মূহুর্তে করোনা সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। এখন যদি চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা ন্যূনতম নিরাপত্তা দাবি জানানো শুরু করেন, তখন এই কেন্দ্রীয় সরকারই তাঁদের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হবে, বাস্তববোধহীন স্তাবক-ভক্তরা সোশ্যাল মিডিয়ায় চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের “দেশদ্রোহী” বানানোর পবিত্র কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়বেন৷ তবে যে সব ভক্তের বাড়িতেই চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মী আছেন, তাঁরা বোধহয় কেন্দ্রের এই ভয়ঙ্কর দায় এড়ানোর নীতির বিরোধিতাই করবেন৷

কেন্দ্রীয় সরকরের এমন অমানবিক অবস্থানের প্রতিবাদ হওয়া উচিত সর্বস্তর থেকেই৷ কেন্দ্রের এই মনোভাবের অর্থ হল, দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা কোটি কোটি করোনা-যোদ্ধার ন্যূনতম নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে মোদি সরকার রাজি নয়৷ নির্লজ্জভাবে কেন্দ্র সেই দায়িত্ব চিকিৎএকদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে৷
কেন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই অভিযোগ ছিলো,
চিকিৎসাকর্মীদের পর্যাপ্ত সংখ্যায় PPE দিতে ব্যর্থ সরকর৷ অভিযোগ আছে এই নরেন্দ্র মোদি সরকারই বেশি দাম দিয়ে চিন থেকে ত্রুটিপূর্ণ কিট কিনেছে৷ এই কিট প্রয়োজনের সময় ব্যবহার করা যায়নি৷

দেশজুড়ে চিকিৎসক,নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা, যারা প্রকৃতই করোনা- যোদ্ধা, তাঁরা জীবনের মায়া না করেই লড়াই চালাচ্ছেন৷ আর কেন্দ্র হাত ধুয়ে ফেলে বলছে “যাও, এবার থেকে নিজেরাই ঠিক করো বাঁচবে, না মরবে !”

এরপরে যদি চিকিৎসক,নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা অধিকতর সচেতন হয়ে নিয়মমাফিক চিকিৎসার পথে হাঁটতে শুরু করেন, বিপন্ন হবেন দেশের সাধারণ মানু করে দীর্ঘায়িত হবে মৃতের তালিকা!

দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দল এই দায় নিতে তৈরি তো ?