চরমতম ব্যর্থতা ঢাকার ‘খেলা’ শুরু করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার তথা কেন্দ্রের শাসক দল৷
একদিকে চরম অদক্ষতা, ভুল পরিকল্পনা৷ শোম্যানশিপ-কেই অগ্রাধিকার দেওয়া৷ স্তাবকদের তৈলমর্দনকে বাস্তব ধরে নেওয়া৷ সব ‘ক্রেডিট’ নিজের নামের পাশে জুড়তে গিয়ে করোনা সামলাতে একের পর এক বেড়ালদের বাঘ বানিয়ে বাজারে ছাড়া৷ এ সবের ফল যা হওয়ার তাই-ই হয়েছে৷ ‘জয়েন্ট কোভিড টাস্ক ফোর্স’-এর বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, “কেন্দ্রীয় সরকার স্বীকার করুক বা না করুক, ভারতের বিপুল পরিমাণে আক্রান্তের সংখ্যা এটাই প্রমাণ করছে যে এখানে ‘কম্যুনিটি ট্রান্সমিশন’ হয়ে গিয়েছে”৷
গোটা বিশ্বের প্রায় সব দেশই যখন করোনা- যুদ্ধের লাগাম সঠিক হাতে তুলে দিয়েও সামলাতে বেগ পাচ্ছে বা পেয়েছে, সেখানে এ দেশে করোনা-মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের স্টিয়ারিং তুলে দেওয়া হয়েছে একপাল অযোগ্য, অদক্ষ হাতে৷ ‘জয়েন্ট কোভিড টাস্ক ফোর্স’, ইন্ডিয়ান পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন, ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অফ প্রিভেনটিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিন এবং ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অফ এপিডেমিওলজিস্টস সংগঠন তাই সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকেই জানিয়েছে, “করোনা-যুদ্ধে ভারত সরকার মহামারি বিশেষজ্ঞ বা এপিডেমিওলজিস্টের পরামর্শ নেয়নি৷ যদি নিত, তাহলে এই পরিস্থিতি অনেকটা ভালো হতে পারত।”
লকডাউনের প্রথম দিন থেকেই মোদি সরকারের পদক্ষেপসমূহ দেশবাসীকে বুঝিয়েছে, কেন্দ্র মহামারি নিয়ন্ত্রণের ভার তুলে দিয়েছে বিজেপি আইটি সেলের চেয়ারম্যান অমিত মালব্য, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের যুগ্মসচিব লভ আগরওয়াল, বাংলার রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড় সাহেবের মতো কিছু ‘বন্দিত’ ‘মহামারি- বিশেষজ্ঞ’-দের ‘যোগ্য’ হাতে৷ অমিত মালব্য এবং
জগদীপ ধনকড় সাহেব নিরাপদ ঘেরাটোপে বসে ডে-ওয়ান থেকে গঠনমূলক উদ্যোগের পরিবর্তে তাঁদের টুইটার হ্যাণ্ডলকে করোনা- নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপযুক্ত হাতিয়ার মনে করলেন৷ ‘দৃষ্টিহীন এবং কাণ্ডজ্ঞানহীন’ স্তাবকরা সেই সব বাণীকেই বাইবেল ঠাওরালেন৷ নিজেদের বিচারবোধ প্রয়োগ না করে এই সব বক্তব্যের ধুয়ো ধরলেন৷ বোঝানোর চেষ্টা করলেন, মোদিজির সুযোগ্য নেতৃত্বে করোনা দেশ ছেড়ে পালানোর মুখে৷
গত ১০ এপ্রিল WHO বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছিলো, ভারতে গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হওয়ার মুখে। সেই সময় WHO-এর দাবি খারিজ করে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক। মন্ত্রকের যুগ্মসচিব লভ আগরওয়াল বলেছিলেন, “দেশে যদি গোষ্ঠী সংক্রমণের পরিস্থিতি তৈরি হয়, তাহলে আমরাই তা সবার আগে বুঝবো এবং জানাবো। আমরা জনগণকে বলবো সতর্ক থাকতে৷ এখনও গোষ্ঠী সংক্রমণ হয়নি।”
আরও বহুধাপ এগিয়ে গত ২৪ এপ্রিল কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধন দাবি করেছিলেন, “কেন্দ্রীয় সরকারের তৎপরতায় দেশে করোনা গোষ্ঠী সংক্রমণের পর্যায়ে পৌঁছয়নি। মোদি সরকারের নেওয়া একাধিক পদক্ষেপের কারণেই ভারতের পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে অনেক ভালো৷” এই কঠিন পরিস্থিতিতে একটা রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যমন্ত্রীও গা ভাসালেন গড্ডালিকা প্রবাহে৷ দুর্ভাগ্যজনক৷
দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রকের তথ্যই বলছে
করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে মুখ থুবড়ে পড়েছে মোদি সরকার৷ থালা বাজিয়ে বা হ্যারিকেন জ্বালিয়ে যে করোনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়, দেশের ১৩০ কোটি মানুষ আজ জীবন দিয়ে বুঝছেন৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন,করোনা-যুদ্ধে কেন্দ্রের একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তের খেসারত দিতে হচ্ছে ভারতবাসীকে৷
করোনা পরিস্থিতি প্রতিদিন আগের দিনের থেকে আরও খারাপ হচ্ছে।
বুধবার সকাল ৮টায় দেওয়া কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের
হিসাব বলছে, দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২,০৭,৬১৫৷
শেষ ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্তের সংখ্যা একধাক্কায় বেড়েছে ৮,৯০৯। অন্যদিকে শেষ ২৪ ঘণ্টায় ২১৭ জন করোনা আক্রান্তের মৃত্যু হয়েছে। ফলে মোট মৃতের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৫,৮১৫-এ।
একইসঙ্গে মোদিজির মুকুটেও নতুন পালক সংযোজিত হয়েছে৷ করোনা আক্রান্তের সংখ্যার বিচারে বিশ্বের মধ্যে সপ্তম স্থানে উঠে এসেছে ভারত। ইতিমধ্যেই ভারত হারিয়ে দিয়েছে জার্মানি, ফ্রান্স, চিন, ইরানের মতো ভয়ঙ্কর করোনা প্রভাবিত দেশগুলিকে। সব মিলিয়ে ভারতের পরিস্থিতি যে আগের থেকে আরও ভয়াবহ হয়েছে, সেটাই প্রমাণ করছে সরকারি পরিসংখ্যান। বিপর্যয় মোকাবিলা করার দক্ষতার প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকার আজ ‘উলঙ্গ- রাজা’৷ স্বাভাবিকভাবেই দেশজুড়ে শুরু হয়েছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের তীব্র সমালোচনা৷ বারবার ঘুঘু ধান খেয়ে যেতে পারেনা৷ একবার না একবার ধরা পড়তেই হবে৷ নোটবন্দি, এনআরসি, সিএএ, রাফাল, বেলাগাম বেকারত্ব, আর্থিক মন্দা, ইত্যাদির সময় ‘মিঁত্রো’ উৎরে গেলেও, এই করোনা নামক ফাঁটা বাঁশে আটকে গিয়েছে সবকিছু৷
কড়া লকডাউনেও কেন বাড়ছে করোনা-সংক্রমণ? প্রশ্নের মুখে কেন্দ্র৷ উত্তর মেলেনি৷ সম্ভাবনাও নেই৷
তাই নরেন্দ্র মোদির সরকার এখন মুখ লুকাতে নানা ফিকির খুঁজছে৷ দেশবাসীর এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির নজর করোনা থেকে সরানোর কৌশলও প্রায় তৈরি করে ফেলেছেন মোদি-শাহ জুটি৷ দেশের মানুষের সামনে যুদ্ধ-যুদ্ধ আবহ তুলে ধরা এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিকে ভুল বোঝাতে সন্তর্পনে ভোটের গল্প বাজারে ছাড়ার সলতে পাকানো শেষ৷ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ধীর গতিতে সেই পথে হাঁটাও শুরু করে দিয়েছেন৷
এদিকে আচমকাই ভোট করতে কেন্দ্রের সবুজ সংকেত পেয়ে গিয়েছে জাতীয় নির্বাচন কমিশন ৷ কমিশন জানিয়েছে, রাজ্যসভার ১৮ আসনের ভোট হবে আগামী ১৯ জুন৷ অন্ধ্রপ্রদেশ, গুজরাতের ৮টি আসন, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থানের ৬টি আসন, ঝাড়খণ্ডের ২টি, মণিপুর ও মেঘালয়ের ২টি আসনে ভোট হবে৷ ১৯ জুন বিকেলেই ভোট গণনা৷ অনেকেরই ধারনা, করোনা থেকে আলোচনা সরাতে মাপা ছকে এই কাণ্ড ঘটিয়েছেন মোদি-শাহ৷
ওদিকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নিজেই অন্য ‘খেলা’ হাতে নিয়েছেন৷ করোনা- পূর্ববর্তী মেজাজে বিরোধী-শাসিত রাজ্যগুলির বিরুদ্ধে এই ভয়ঙ্কর করোনা- সংক্রমণকালেও ছক কষে আক্রমণ শুরু করেছেন শাহ৷ দ্বিতীয় মোদি সরকারের বর্ষপূর্তির দিন থেকেই শাহ ভোটের দামামা বাজানোর কাজ শুরু করেছেন৷ সেদিন এক টিভি সাক্ষাৎকারে অমিত শাহ বলেছেন, “বাংলায় হিংসার ঘটনার নিরিখে ওখানে বদল প্রয়োজন”৷ এই পরিস্থিতিতে কোনও দায়িত্বপূর্ণ পদাধিকারী কারন ছাড়া এ ধরনের উসকানি কেন দেবেন ? বিজেপি-বিরোধী শিবিরের অন্যতম বৃহৎ দুর্গ এই বাংলা৷ করোনা মোকাবিলায় কেন্দ্রের সীমাহীন ব্যর্থতার বিরুদ্ধে আওয়াজ বেশি উঠবে বাংলা থেকেই, স্বাভাবিকভাবেই৷ তাই অন্যভাবে বাংলাকে আক্রমণ করলে রাজ্যের শাসক দল সেদিকেই নজর বেশি দেবে৷ করোনা একটু পিছিয়ে যাবে৷ সেই অঙ্কেই এগোচ্ছেন অমিত শাহ ৷
পাশাপাশি হাল্লা রাজার সেই মন্ত্রীর স্টাইলে কেন্দ্র যুদ্ধ – যুদ্ধ একটা জিগির তোলারও চেষ্টা চালাচ্ছে৷ চিন, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নিদেনপক্ষে নেপাল হলেও চলবে৷ করোনা-ব্যর্থতা সামলানোর সেরা অস্ত্র যুদ্ধের আবহ তৈরি করা৷ সেই আবহে করোনা- ব্যর্থতার কথা তুললে রে রে করে বলা যাবে, “এই কঠিন পরিস্থিতিতে যারা রাজনীতি করছে, তারা দেশবিরোধী”৷ এই প্রসঙ্গে একটা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে৷ নেপাল পৃথিবীর একমাত্র হিন্দুরাষ্ট্র৷ ভক্তদের নজরে নরেন্দ্র মোদি এই মুহুর্তে তাবৎ হিন্দু সমাজের ‘অবিসংবাদী কুলতিলক’৷ তাহলে ওই একরত্তি
হিন্দুরাষ্ট্র নেপাল ‘অবিসংবাদী কুলতিলক’-কে কুকরি দেখাচ্ছে কোন লজিকে ?
এসবই এখন একমাত্র পথ৷ নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব এবং ক্ষমতা ধরে রাখতে বিকল্প আর কোনও পথই বিজেপির সামনে খোলা নেই৷ সেই পথ ধরেই এখন হাঁটতে চাইছে কেন্দ্র৷
করোনাভাইরাস ৫৬ ইঞ্চি ছাতিকে নামিয়ে কত ইঞ্চি বানিয়েছে, তা দু’দিন বাদেই জানা যাবে৷ ‘জাতির উদ্দেশ্যে’ প্রধানমন্ত্রীর নানা ফরম্যাটের বক্তৃতা এখন বাজারে খাচ্ছে কম৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে দেশের মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশই করোনা-আক্রান্ত হতে পারে”৷
তাই এখন দেশবাসীর সামনে দলীয় রাজনীতির কূটকচালি ফেরাতে হবে৷ ভোটের গল্প ছাড়তে হবে৷ যুদ্ধের হাওয়া তুলতে হবে৷
গভীর নিষ্ঠায় সে কাজেই হাত লাগিয়েছেন ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রনায়করা৷































































































































