( আনন্দবাজারের পদত্যাগী সম্পাদক সম্পর্কে সামাজিক মাধ্যমে এক সহকর্মীর কলম।)
দুটো ঘটনা পরপর ঘটলে তাদের মধ্যে সম্পর্ক মন আপনিই খাড়া করে নেয়। এটা চিন্তার স্বাভাবিক ঝোঁক।
গত শনিবার অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়কে ডেকে পাঠাল হেয়ার স্ট্রেট থানা, আর রবিবার তিনি ইস্তফা দিলেন আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক পদ থেকে, এ দুটোর মধ্যে কার্য-কারণ সম্পর্ক সে ভাবেই তৈরি হয়েছে। আবার কিছু রাজনৈতিক দল ধুয়ো তুলছেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাপে তিনি ইস্তফা দিলেন। মিডিয়ার স্বাধীনতা নিয়ে মহা শোরগোল পড়েছে।
মিডিয়ার প্রতি ভারতের কোন রাজনৈতিক দল যে ভদ্র-সভ্য, সংবিধান-সম্মত ব্যবহার করছে, সে প্রশ্ন না-ই বা তুললাম। আপাতত এটুকু বলা দরকার যে, কিছু আধা-সত্য, কিছু পুরো-মিথ্যে, আর কিছু প্রায়-সত্য কথা মিলে যে খিচুড়িটা তৈরি হয়েছে, সেটা ‘খবর’ বলে পাতে দেওয়ার যোগ্য নয়। কিন্তু সংবাদ-নির্মাণের স্বাভাবিক নিয়ম মেনেই কোনও মিডিয়া এমন একটি অভ্যন্তরীণ বিষয়কে নিয়ে লিখবে না। লেখা উচিতও নয়। সম্ভবত ফেসবুকেও নয়। আমি জানি, অনির্বাণদা এ বিষয়ে একটি শব্দ লেখাও অনুমোদন করবেন না, খুব বিরক্ত হবেন।
অথচ সর্বপ্রকারে সম্মানযোগ্য ব্যক্তির অকারণ অসম্মান চুপ করে দেখা-শোনার মধ্যে একটা কাপুরুষতা আছে। যা মনে পীড়া দেয়, সংকুচিত করে। যা প্রতিবাদের যোগ্য, তার প্রতিবাদ না করলে নিজের অযোগ্যতাই প্রতিপন্ন হয়।
তাই অল্প কয়েকটি কথা বলব। এক, অনির্বাণদার ইস্তফার সিদ্ধান্ত পাকা হয়েছিল আগেই। অবসরের সময় পেরিয়ে গিয়েও কাজ করছিলেন। নিজের কাজকর্ম, লেখালেখির জন্য দায়িত্ব ছাড়তে চেয়েও পারছিলেন না। কোভিড-১৯, আমপানের খবর নিয়ে বিতর্ক, বা সাম্প্রতিক মামলার নোটিসের অনেক আগেই শেষ অবধি তা পেরেছিলেন। দুই, হেয়ার স্ট্রিট থানায় তাঁকে তলব করা হলেও তিনি যাননি, আইনজীবীর চিঠি পাঠিয়েছিলেন। অতএব তাঁকে ছঘণ্টা বসিয়ে জেরার কথাটা ভুল। তিন, রাজনৈতিক চাপ তাঁর কাছে নতুন নয়। দায়িত্বশীল পদে যে সাংবাদিক দীর্ঘ দিন কাজ করেছেন, এবং পাঠকের একটি বড় অংশের কাছে আস্থাভাজনও থেকেছেন, চাপ সহ্য করার ক্ষমতা তাঁদের কবচ-কুন্ডল। সহজাত নয়, কষ্টার্জিত। আনন্দবাজার অফিসেই কয়েক ডজন সাংবাদিক মিলবে, যাঁদের নামে লক্ষ বা কোটি টাকার মোকদ্দমা ঝুলছে। যেখানে নেতারা প্রকাশ্যে সাংবাদিককে গ্রেফতার করার হুমকি দেন, সেখানে মামলার নোটিস এলেই যদি সাংবাদিকরা পদত্যাগ করত, তা হলে কাগজ-চ্যানেল চলত না। চাপের মুখে পদত্যাগ, এ কথাটা কেবল অপমানজনক নয়, সর্বৈব মিথ্যা।
কারণ অনির্বাণদার মতো সাহসী মানুষ খুব কম দেখেছি। তাঁর কাছে শিখেছি, সাহস মানে গলা তুলে আস্ফালন নয়। শান্ত ভাবে অন্যায় কথা, অর্থহীন যুক্তি প্রতিরোধ করতে সাহস লাগে। অন্যের কথায় যদি যুক্তি থাকে, তাকে সম্মান করে নিজের মত পরিবর্তন করতে সাহস লাগে। আবার নিজের মতে অবিচল থেকে ভিন্ন মতকে সম্মান করতেও সাহস লাগে। কাগজের বড়-মেজ কর্তা থেকে চা-ওয়ালা, পিয়ন, সকলকে সমান ভাবে সম্মান করে কথা বলতেও সাহস লাগে।
অনির্বাণদা ব্যতিক্রমহীন ভাবে এই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলির চর্চা করে গিয়েছেন বলে তাঁর ডিপার্টমেন্টে একটা ভিন্ন বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল। আনন্দবাজারে দীর্ঘ দিন কাজের সূত্রে দেখেছি, এক সময়ে নিউজ রুমের অকারণ অপশব্দের আস্ফালন, পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্য, আর সর্বত্র “তুই আমার সামনে মুখ খুলিস কোন সাহসে” ধরনের ফালতু ইগোর লড়াই এক অসহনীয় পরিবেশ তৈরি করেছিল। অথচ সম্পাদকীয় বিভাগে তা থেকে এক সম্পূর্ণ আলাদা সংস্কৃতি ছিল। যা স্বস্তিদায়ক, উৎসাহদায়ক, যা চিন্তার আদান-প্রদানে খোলামেলা, পরস্পর আস্থা ও সম্মানের উপর স্থাপিত।
অনির্বাণদা ২০১৬ সালে কাগজের সম্পাদক হওয়ার পর এই কর্মসংস্কৃতি গোটা আনন্দবাজারে অনেকটাই ছড়িয়েছে। নিজে পুরুষ হয়ে পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান, নিজে হাতে ক্ষমতা পেয়েও আধিপত্য জাহির করায় আপত্তি, একটি সংস্থার শীর্ষে থেকেও একটিও অনুশাসন না ভাঙা, এ যদি সাহস না হয় তা হলে সাহস কী? আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা সংযমকে সংকোচ আর নিয়মপালনকে দুর্বলতা বলে ভাবতে শিখেছি।
সংবাদমাধ্যম আর সাংবাদিকরা কতটা চাপমুক্ত হয়ে কাজ করছে, সেটা নিশ্চয়ই গুরুতর প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের চর্চা যে অনির্বাণদার ইস্তফা নিয়ে গুলতানির সঙ্গে জুড়ে গেল, এটাই আক্ষেপ। তবে আশ্চর্য নয়। এমনিতেই বাঙালির পরচর্চা লেজেন্ডারি, তার ওপর আনন্দবাজারের খবর চিরকালই আনন্দবাজারের বাইরের লোক বেশি রাখে। যা সব পিলে-চমকানো কথা শুনেছি, আরে ছ্যা ছ্যা, ও লেখা যায় না! এখন চলছে কাগজের সঙ্গে সম্পাদকের সম্পর্ক নিয়ে রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজ। অনির্বাণদা কি কাগজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সব বিষয়ে এক মত হয়েছেন? নিশ্চয়ই হননি, কোনও সম্পাদকই হন না। তাই তাঁর ইস্তফা নিয়ে চর্চা হবেই। সে চলুক, তবে আজকের কনফার্মড খবর, অনির্বাণদা এখন আরও বেশি করে লিখবেন। হ্যাঁ, আনন্দবাজারের চার নম্বর পাতায়।































































































































