“জীবাণুমুক্ত” টিকিয়াপাড়া, এবার চন্দননগর কাণ্ডে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক “রক্ষক-ভক্ষক” পুলিশের!

0
1

মারণ ভাইরাস করোনার বিরুদ্ধে যখন গোটা দুনিয়ার মতো টানটান উত্তেজনায় যুদ্ধ চলছে, ঠিক তারই মধ্যে “মজার মুল্লুক” তৈরি হয়েছে কিছু কিছু জায়গায়। মানব সভ্যতাকে রক্ষা করতে যাঁরা নিবেদিত প্রাণ। যাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে

সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে লড়াই করছেন। যাঁরা পরিবার-পরিজন ছেড়ে হাসি মুখে মানব সেবায় ব্রতী হয়েছেন, এই সঙ্কটকালে তাঁরাই বেশি প্রহৃত হচ্ছেন।
সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে এমন কিছু ঘটনা যা রোজই সামনে চলে আসছে। এই কঠিন পরিস্থিতিতে এইসব অনভিপ্রেত-বর্বরোচিত ঘটনা সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে।

এমন অসংখ্য ঘটনার মধ্যে অতি সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনা তুলে ধরলেই বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। দু’দিন আগে হাওড়ার টিকিয়াপাড়ায় একদল উৎশৃঙ্খল-অসভ্য-অবাধ্য দায়িত্ব পালন করতে যাওয়া পুলিশের উপর আক্রমণ করলো। করোনার জন্য রেড জোন হাওড়া এখন খুবই স্পর্শকাতর। সরকারের পক্ষ থেকে সেখানে সামাজিক দূরত্ব পালনে কঠোর ভাবে লকডাউন বিধি পালনের নির্দেশ রয়েছে। অথচ, অবাধে বিচরণ করা এক শ্ৰেণীর মানুষকে আইন-শৃঙ্খলা মানতে বলায় উর্দিধারীরাই লাঞ্ছনার শিকার হলো। করোনা যুদ্ধের মধ্যে মুষ্টিমেয় কিছু সমাজ বিরোধীর এমন কাণ্ড কারখানা, যা পুলিশ সমাজের মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। তবে খুব দ্রুত সঙ্গে কড়া হাতে আইনের শাসন জারি রেখে সমাজের কীটগুলিকে শায়েস্তা করে “জীবাণুমুক্ত” করা হয়েছে টিকিয়াপাড়াকে। উর্দিধারীদের স্যালুট জানাচ্ছেন মানুষ। একজোট হয়েছে প্রশাসন। মনোবল ফিরে পেয়েছে পুলিশ।

এটা যদি হয় কয়েনের একপিঠ। তাহলে অন্যদিকটিও আছে। এবার ঘটনা হুগলি জেলার চন্দন নগরের। লকডাউন পালনে পুলিশ রাস্তায় দাঁড়িয়ে ডিউটি করছিল। চলছিল নাকা চেকিং। এরই মাঝে ঘটল এক লজ্জাজনক ঘটনা।
ডিউটিতে যাওয়ার সময় পথ আটকে কর্তব্যরত নার্সকে চড় মারার ঘটনা ঘটলো। এবার কাঠগড়ায় পুলিশ। ঘটনা একেবারেই নজিরবিহীন। হাসপাতালে ডিউটি করতে যাওয়ার পথে এক নার্সকে চড় মারা হয়। এবং সেই ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল। যা নিয়ে নেটিজেনরা সমালোচনার ঝড় তুলেছে।

জানা গিয়েছে, অদিতি সিংহ রায় নামে নার্সের কাজ করা
এক যুবতী সিঙ্গুর থেকে আসছিলেন কাজে যোগ দিতে। সঙ্গে ছিলেন তাঁর হবু স্বামী। রাত্রিবেলা ফাঁকা রাস্তা দিয়ে অনেকটা যেতে হবেই হবু স্বামীকে সঙ্গে নিয়েছিলেন ওই নার্স।

জরুরি পরিষেবার জন্য অন্যদের মতো এখন ৮ ঘন্টার পরিবর্তে ১২ ঘণ্টা ডিউটি করতে হচ্ছে অদিতিকেও। সে চন্দননগর মহকুমা হাসপাতালের নার্স বলে জানা গিয়েছে। লকডাউনে ডিউটি করতে যাওয়ার জন্যই তাঁর কাছে এন্ট্রি পাসও ছিল। কিন্তু তা সত্বেও চন্দননগর থানার পুলিশ নাকা চেকিং-এর সময় তাঁদের পথ আটকায়। শুরু হয় বাকবিতণ্ডা। উত্তেজনা কিছুটা বাড়লে নার্সকে হঠাৎই সপাটে চড় মারেন এক মহিলা পুলিশ কর্মী। পরে নার্সকে চন্দননগর থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। এবং হসপিটাল সুপারের সঙ্গে কথা বলেই তাঁকে ছাড়া হয়। এই ঘটনায় খুবই মর্মাহত অদিতি। এই বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই চন্দননগর পুলিশ কমিশনারেটে অভিযোগ জানানো হয়েছে। সূত্রের খবর, এই ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে ওই নার্সকে।

কিন্তু বিচার বিভাগীয় তদন্তে কি এই ঘটনার সমাধান সম্ভব? কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার কঠোরভাবে জানিয়ে দিয়েছে, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের আক্রান্ত-এর ঘটনা ঘটলে কড়া হাতে তা দমন করা হবে। এবং আমাদের দেশের সংবিধান বলে, আইন সকলের জন্য সমান। তাহলে উপযুক্ত প্রমাণপত্র থাকা সত্বেও কেন করোনা যুদ্ধের সৈনিক অদিতি সিংহ রায়কে প্রকাশ্যে রাস্তায় জনৈক মহিলা পুলিশকর্মীর হাতে চড় খেতে হলো? এখানে কি আইনের শাসন বজায় থাকলো? এই ঘটনায় কি কুৎসিত ভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার হলো না? মুষ্টিমেয় এমন অযোগ্য পুলিশের জন্য কি গোটা পুলিশ সমাজ কলঙ্কিত হলো না? এমন ভুরি ভুরি প্রশ্ন কিন্তু উঠতে শুরু করেছে বিভিন্ন মহলে।

চন্দননগর কাণ্ডে যেখানে পুলিশের উচিত ছিল “যুদ্ধক্ষেত্রে” যাওয়া কর্তব্যে অবিচল ওই নার্সকে রাতের বেলা নিরাপত্তা দিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া, সেখানে তাঁর পথ আটকে মারধর করা কোন সুস্থ সমাজের পরিচয় বহন করে? এইরকম কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনাই কিন্তু পুলিশের উপর তৈরি হওয়া আস্থা-ভরসা-বিশ্বাস ভেঙে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সেক্ষেত্রে ঘৃণা থেকে পুলিশের উপর আক্রমণের বিরূপ মনোভাব বাড়িয়ে দিতে পারে।

লকডাউন না মানলে অবাধ্যদের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে উঠবোস এখন যদি সমর্থন যোগ্য হয়, তাহলে সরকারের নির্দেশকে বুড়ো আঙুল দেখানোর জন্য ক্ষমতার অপব্যবহারকারী ওই মহিলা পুলিশ কর্মী কেন তার কৃত কর্মের জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইবে না? কেন তাকে সাসপেন্ড করে নজির তৈরি করা হবে না? মুষ্টিমেয় কিছু পুলিশের রক্ষক ভক্ষক মনোভাবের জন্য পুলিশ মহল কেন বদনামের শিকার হবে?

আজ যদি ওই মহিলা পুলিশ কর্মীর উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা হয়, তাহলে তা সমাজের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আর যদি সেটা না হয় তাহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে। কারণ, টিকিয়াপাড়ার ঘটনা যদি পুলিশের মনোবলে চিড় ধরায়, তাহলে মনে রাখা দরকার চন্দন নগরে পুলিশের হাতে নার্স নিগ্রহের ঘটনা এই করোনা সঙ্কটকালে গোটা চিকিৎসক সমাজের মনোবল ভাঙার জন্য যথেষ্ট।

তাই টিকিয়াপাড়ায় সমাজের কীটগুলির যেমন কঠোর শাস্তির প্রয়োজন। ঠিক একইভাবে এক দেশ, এক আইন বজায় রেখে অবিলম্বে ওই পুলিশ কর্মীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। অন্যথায় ঘুরে ফিরে আসবে সেই কথা, “সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র…।