করোনা-আবহে সামাজিক দূরত্ব রেখেই রমজানে তৈরি ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা, কণাদ দাশগুপ্তর কলম

0
3
কণাদ দাশগুপ্ত

করোনা-আবহ যে পরিবর্তিত পরিস্থিতি তৈরি করেছে, তার সঙ্গে খাপ খাইয়েই এ বছরের রমজান মাসের অপেক্ষায় বিশ্বের মুসলিম সমাজ৷ একদম ভিন্ন এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবেন ধর্মপ্রাণ এই সম্প্রদায়৷ একই অবস্থানে এদেশ এবং এ রাজ্যের মুসলিমরাও৷ এবার মুসলিমদের যে ধরণের বিধিনিষেধের মধ্যে রোজা পালন করতে হবে, তার নজির ইতিহাসে বিরল। এমন পরিস্থিতি সম্ভবত অতীতে কখনও আসেনি৷ বিশ্বযুদ্ধ এসেছে, অসংখ্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ এসেছে, কিন্তু অতীতের কোনও লেখায় বা সাহিত্যে বর্তমান পরিস্থিতির মত কিছুই পাওয়া যায় না। যুদ্ধ বা দুর্যোগের সময়েও মুসলিমরা রমজানের সময় একসঙ্গে তাদের ধর্মীয় আচার পালন করেছে, এমন নজিরই আছে৷ ধর্মাচরনে, বিশেষ করে রোজা বা ঈদে এ ধরনের সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বা সোশ্যাল-ডিসট্যান্সিং ইসলামের ঐতিহ্যের হয়তো পরিপন্থী। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে ভারত-সহ বিশ্বের কোটি কোটি মুসলিম এবার তৈরি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনেই রোজা পালন করার জন্য। তাদের মাথায় আছে, রমজান মাসে বিশেষ সতর্কতা জারি করে সব দেশের সরকারকে গাইডলাইন দিয়েছে WHO বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৷

তাহলে কেমন হতে পারে করোনা মহামারি-কালের এ বছরের রমজান মাসের রোজা, ইফতার ?

এ বছর করোনার আবহে রমজান পালনে বেশকিছু নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন মুসলিম ধর্মগুরুরাই৷ এই মুহুর্তে গৃহবন্দি ভারতবাসী। লকডাউনের বিধিনিষেধ মেনে চলার জন্য প্রত্যেকের উপর কড়া নির্দেশিকা জারি আছে। দিল্লির জামা মসজিদের ইমাম সৈয়দ আহমেদ বুখারি বাড়িতে থেকেই রমজান পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “যদি আমরা সরকারি নির্দেশ মেনে চলি তাহলে দ্রুত করোনাকে সমূলে ধ্বংস করতে পারব। রমজানের পবিত্র মাস শুরু হতে চলেছে। ওই সময়ে আমরা বাড়িতে থেকে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই প্রার্থনা ও সমস্ত কাজ করব। এই নিয়ম মেনে চললে আমরা সবাইকে করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচাতে পারব।’
কলকাতার নাখোদা মসজিদের ইমাম মহম্মদ সফি জানিয়েছেন, মসজিদে এসে নয়, নামাজপাঠ করতে হবে বাড়িতে বসে, সব নিয়ম মেনে৷ বেঙ্গল ইমাম অ্যাসোসিয়শনও একই বার্তা দিয়েছে৷ সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিভিন্ন সংগঠনও সতর্কতার সঙ্গে রমজান পালনের আহ্বান জানিয়েছে৷ সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশনের সাধারন সম্পাদক মহম্মদ কামরুজ্জমান বলেছেন, “আগে সুস্থ থাকতে হবে৷ সুস্থ থাকতে হলে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মানতে হবে৷ জেদ করে কিছু করলে, ক্ষতি হবে নিজেদেরই”৷ দেশের মুসলিম সমাজকে বাড়িতে থেকেই রমজান মাস পালন করার অনুরোধ জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু উন্নয়ন মন্ত্রী মুক্তার আব্বাস নাকভি। তিনি বলেছেন, দেশে জারি থাকা নিষেধাজ্ঞা মেনে চললে সাধারণ মানুষের লাভ হবে৷

দেখা যাচ্ছে সচেতন মুসলিম সমাজ নিজেরাই সতর্ক৷ তারাই বলছেন, রমজানের নামাজের জন্য জমায়েত করা যাবে না, নামাজ পড়তে হবে ঘরে বসেই। তাই সেইভাবেই চলছে রমজানের প্রস্তুতি পর্ব। সম্ভবত আগামীকাল, শনিবার থেকে মুসলিমদের পবিত্রতম রমজান মাস শুরু হচ্ছে৷ ২৮-৩০ দিন পর্যন্ত চলে এই রমজান। ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষ গোটা রমজান মাস নির্জলা উপবাস করেন সারাদিন । রাতে নামাজ পড়ে একবারই খেয়ে থাকেন৷
বিশ্ব আজ যতই আতঙ্কিত হোক, থেমে নেই মানুষের জীবন৷ থেমে থাকে না বহু বছর ধরে চলে আসা রীতি-নীতি বা ধর্মীয় অনুষ্ঠান। সব ধর্মের মানুষই যে যার মতো ধর্মাচরন করবেই৷
মুসলিমরা এ বছর প্রথামত স্বজন বা প্রতিবেশীদের নিয়ে সন্ধ্যায় ইফতারি করতে পারবেন না৷ রাতে দলবেঁধে মসজিদে গিয়ে তারাবির নামাজ পড়তে পারবেন না। মসজিদে রমজানে নামাজ হবে না৷ হয়তো দিনে ৫ বার আজান হতে পারে। যদিও সংবাদ সংস্থার খবর,

◾সৌদি বাদশাহ মক্কা ও মদিনায় মুসলিমদের দুই পবিত্রতম মসজিদে শুধু তারাবি নামাজের অনুমতি দিয়েছে৷ তবে সাধারন নামাজিরা ওখানে যেতে পারবেন না।

◾সৌদি আরবের বিভিন্ন শহরে জারি করা কারফিউ সকাল ৯টা থেকে বিকেলে ৫টা পর্যন্ত কিছুটা শিথিল থাকবে। তবে দুনিয়ার বহু মুসলিম দেশে সেই ছাড়টুকুও দেওয়া হয়নি৷

◾মিশরে রমজান মাসে জামাতে নামাজ-সহ যে কোন ধরনের জমায়েত নিষিদ্ধ।

◾ইরানে আয়াতোল্লাহ আলি খামেনেই রমজান মাসে মুসলিমদের জামাতে নামাজ না পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন৷

◾জেরুজালেমে ইসলামের তৃতীয় পবিত্র মসজিদ আল আকসাতেও রমজানে নামাজ হবেনা শুধু দিনে ৫ বার আজান হবে।

◾মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া সিঙ্গাপুর, ব্রুনেইতেও রমজানের আগে থেকেই মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ার ওপর যে বিধিনিষেধ চলছে, রমজান মাসে তার কোনও ব্যতিক্রম হবে না।

◾ব্রিটেন-সহ ইউরোপের অধিকাংশ দেশেই মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়া এখন বন্ধ এবং এসব দেশেও রমজান মাসে তার ব্যতিক্রম হবে, এমন ইঙ্গিত নেই। ব্রিটেনের মসজিদে রোজার সময় নামাজ, দোয়া-দরুদ বা খুতবা ভিডিওতে লাইভ-স্ট্রিমিং করবে। মুসলিম কাউন্সিল অব ব্রিটেন রমজান উপলক্ষে জন্য যে পরামর্শ দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, জামাতে নামাজ হবেনা৷ মসজিদের গিয়ে তারাবি হবেনা৷ কোনও ধরনের ইফতার পার্টিও করা যাবেনা।

◾গোটা রমজান মাস জুড়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে রাস্তায় যে মেলা হয়, তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

◾তুলনায় পাকিস্তান কিছুটা অন্য অবস্থান নিয়েছে। ওখানে রোজার সময় তারাবি নামাজ অনুমোদন করা হয়েছে৷ তবে শর্ত আছে, নামাজিদের একজনের সাথে অন্যজনের ৬ ফুট ব্যবধান রাখতেই হবে।

◾বাংলাদেশে রমজান মাসে সামাজিক দূরত্ব শিথিল করা হবে কিনা, মসজিদে গিয়ে তারাবি নামাজ পড়ার অনুমতি দেওয়া হবে কিনা, তা এখনও নিশ্চিত নয়।

প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কি
ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা রোজার শেষে এবার তাদের বৃহত্তম বড় ধর্মীয় উৎসব ‘ইদুল ফিতর’ প্রথাগতভাবে উদযাপন করতে পারবে না? সন্দেহ নেই এবারের রমজান মাস হয়তো মুসলিম ইতিহাসে একেবারে ভিন্ন, ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসাবে জায়গা পাবে।

তবে বিশিষ্ট মুসলিম ধর্মগুরুদের বক্তব্য, রমজানের মূল আধ্যাত্মিক শিক্ষা বা আদর্শ এই সতর্কতামূলক ব্যবস্থার কারনে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। একসঙ্গে জড়ো না হয়েও ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা রমজানের আধ্যাত্মিক আদর্শের অনেকটাই অর্জন করতে পারে। নানা দিকে মনোনিবেশ না করতে হলে বরং বেশিই পারে৷ একসঙ্গে মিলিত হওয়ার যে আনন্দ তা হয়তো এবার তেমন থাকবেনা, কিন্তু বিকল্প পথে পরিবারের সঙ্গে সেই যোগাযোগের রাস্তা তো তৈরি হয়েছে এ বছর৷
করোনা- আগ্রাসনের কারনে এবং করোনা রুখতে হয়তো কিছু কাজ বন্ধ রাখতে বাধ্য হতে হচ্ছে, কিন্তু তার মধ্যেও বেঁচে আছে মানুষের বিশ্বাস।

পবিত্র রমজানে এবার সাবির বা সিরাজে হবে না ঢালাও হালিম! পাড়ায় পাড়ায় হবে না কোনও ‘রাজনৈতিক-ইফতার’৷

এবারের রমজানের রোজা বা ইফতার পরিবারের সঙ্গে ঘরে বসেই পালন করতে গোটা দুনিয়ার সঙ্গে মানসিকভাবে তৈরি এ রাজ্যের ধর্মপ্রাণ মুসলিমরাও৷