
করোনা- এই বিশ্ব জোড়া অতিমারীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমরা সবাই যখন দিশেহারা, ক্ষয়ক্ষতির হিসেব করছি, তখন দেখলাম আমরা শুধু হারায়নি, কিছু পেয়েওছি। অনেক কিছু নতুন আলোতে দেখতে শিখছি। সর্বগ্রাসী মৃত্যুর সামনে জাতি-ধর্ম-সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে আমাদের অপরিসীম অসহায়তা। শ্রমের বৈষম্য, মর্যাদা আর গুরুত্ব নতুন করে শিখলাম। নারীবাদীরা অনেক দিন থেকেই আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে নারীর অবমূল্যায়ন করতে গিয়ে আমরা শ্রমের অবমূল্যায়ন করে এসেছি। এই বিপর্যয়ের সামনে দাঁড়িয়ে অনুভব করলাম আমি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বা আমার প্রতিবেশী একজন ব্যাঙ্ককর্মী বা স্বাস্থ্যকর্মী, সাফাইকর্মী, নিরাপত্তা কর্মী বা আমার পাড়ার ছোট্ট সবজিওয়ালা – সবাই কিন্তু এখন মোটামুটি এক তালিকাভুক্ত। লকডাউনে গৃহবন্দি সবাই। অনলাইন ক্লাস চলছে আমার এবং আমার পুত্রদের। সরকারি আমলা হওয়ায় আমার স্বামীকে কিছুটা কাজ বাড়ি-অফিস মিলিয়ে করতে হচ্ছে। তবে এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ থমকে গিয়েছে। আর যাঁরা এই সময় রসদ জুগিয়ে আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন তাঁরা হলেন অজস্র তথাকথিত ‘low skilled , low paid’ মানুষ।
আমার এবং আমার স্বামীর কর্মসূত্রে দীর্ঘদিন ধরেই আমি বেঙ্গালুরু নিবাসী। উত্তর কলকাতায় জন্ম এবং লেখাপড়া করা একটি মেয়ে স্বচ্ছন্দভাবে দক্ষিণী ভাষায় এখন লেকচার দিতে পারে। রোজকার পাড়ার সবজিওয়ালা, ফল বিক্রেতা, মুখ চেনা মুদির সঙ্গে স্থানীয় ভাষাতে কথাও হয়। কিন্তু আমার রোজকার জীবনে এই মানুষগুলোর তেমন গুরুত্ব ছিল কি? এই লকডাউনে এসে দাঁড়িয়ে দেখলাম আমাদের মতো হোয়াইট কালার জবের থেকে সমাজে এঁদের অবদান কোনও অংশে কম নয়। বরং এই অসময়ে এঁরাই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন। এঁদের ছাড়া আমরা অচল।
অনেক ছেলেরা মনে করেন বা ছোটবেলা থেকে শিখে এসেছেন রান্না করা, বাসনমাজা ‘মেয়েলি কাজ’। কিন্তু আজ অনলাইন ফুড ডেলিভারি বা রেস্তোরাঁর অভাবে এই কাজগুলির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন এবং শেখার চেষ্টা করছেন তাঁরা। একে ইতিবাচক বদল ছাড়া আর কী বলব?
তিরুপতি, সিদ্ধি বিনায়ক, মক্কা, ভাটিকান ও আরো অজস্র ধর্মীয় স্থানের বন্ধ দরজা আর হাসপাতালমুখী জনস্রোত প্রমাণ করেছে ধর্ম ব্যক্তিগত বিশ্বাস মাত্র, তা কোনো ভাবেই এই কঠিন পরিস্থিতিতে জাতীয় জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে না। আমাদের নিরন্তর ছুটে চলা ব্যস্ত নাগরিক জীবনে আমরা অনেক সময় বিশ্রামের অছিলায় একাকীত্ব খুঁজেছি কিন্তু এই লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে এই দূরে থাকার চেষ্টা কতটা ভয়ঙ্কর। তবে, সামাজিক দূরত্ব আমাদের মানসিক দূরত্ব কমিয়ে দিয়েছে। কোয়ারেন্টাইন-এ থাকা প্রতিবেশীর দৈনন্দিন জিনিসের ব্যবস্থা বা আবাসনে কর্মরত নিরাপত্তা কর্মীদের জন্য রান্না, প্রতিনিয়ত কেরালা, কর্নাটক, ইটালি বা আমেরিকার বাসিন্দারা কেমন আছেন জানার চেষ্টা- উপলব্ধি করায় আমরা পরিবার, সমাজ, দেশের গন্ডী ছাড়িয়ে এক বিশ্বব্যাপী পরিবারের কথা।
করোনার আকস্মিক স্তব্ধতা পৃথিবীর দূষণ খানিকটা হলেও কম করেছে। অন্যান্য অপরাধ এবং দুর্ঘটনাও লক্ষণীয় ভাবেই কম। জনজীবনের কোলাহল আর দূষণ কম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাখির ডাক, ফুলের গন্ধ ফিরে এসেছে। আমার বাড়ির সামনে রাস্তায় চতুষ্পদদের অবাধ বিচরণ সেটাই মনে করিয়ে দেয়। গ্ৰেটা থার্নবারগের সজল অনুরোধ যা করতে পারেনি, করোনা তা করে দেখিয়েছে। এতকিছুর মধ্যে যখন দেখি নিরাপত্তার সন্ধানে সপরিবারে অজানার পথে হেঁটে চলা, লক্ষ লক্ষ ক্ষুধার্ত – তৃষ্ণার্ত অসংগঠিত পরিযায়ী শ্রমিকের দল তখন বুঝতে পারি লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব, স্যানিটাইজেশন তাঁদের জন্যই সম্ভব যাঁদের মাথার ওপর ছাদ আছে, রোজগারের নিরাপত্তা আছে, আয় আছে, যাঁদের কলে জল পড়ে, তাঁরাই বোধ হয় করোনার ‘সুফল’ কিছুটা হলেও অনুভব করবে। বাকিদের জন্য শুধুই অন্ধকার।