সময় এসেছে, সরব হোন, সক্রিয় হোন, কণাদ দাশগুপ্তের কলম

0
3
কণাদ দাশগুপ্ত্য

প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে সেদিন অনেকেই নিরাপদে বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে চিকিৎসক- স্বাস্থ্যকর্মীদের ‘ধন্যবাদ’ জানিয়ে ঘটি-বাটি-ঘন্টা বাজিয়েছিলেন৷ সময় এসেছে, এবার নিজেদের এলাকায় ওনারা একটু সক্রিয় হোন, ওই চিকিৎসক- নার্স- স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্যই৷

করোনা-আক্রান্তদের রক্ষা করতে বিভিন্ন হাসপাতালে দিনরাত এক করে লড়াই চালাচ্ছেন এমন অনেক চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীকে নিজেদের বাসস্থানের এলাকায় গত ৩-৪ দিন ধরে বাড়িওয়ালা বা প্রতিবেশীদের বয়কটের মুখে পড়তে হচ্ছে৷ উদ্বেগজনকভাবে এমন খবর ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ পুলিশ প্রশাসন অবশ্যই বিষয়টি দেখছে, কিন্তু এই অপরাধ স্তব্ধ করতে আমাদেরও তো সামাজিক দায়িত্ব আছে৷ সব কিছুই পুলিশ বা প্রশাসন সমাধান করতে পারেনা৷ এই কঠিন পরিস্থিতিতে নাগরিকদের দায়িত্বও কম নয়৷ নিজেদের জীবন বিপন্ন করে যারা আমাদের সুস্থ রাখার যুদ্ধ চালাচ্ছেন, তাঁদের পাশে দাঁড়াতেই হবে৷ কিছু অর্বাচীন, স্বার্থপরের এই অমানবিক হুমকির মোকাবিলা করতে আজ যদি আমরা সক্রিয় না হই, তাহলে চিকিৎসক- স্বাস্থ্যকর্মীদের উদ্দেশ্যে যে অভিবাদন সেদিন জানানো হয়েছিল, তার আন্তরিকতা নিয়েই তো প্রশ্ন উঠবে।
সংবাদমাধ্যমে একের পর এক দেখা যাচ্ছে, হাসপাতালের ডিউটি সেরে বিধ্বস্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরে একাধিক চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের বাড়িওয়ালা বা এলাকার মানুষের হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে৷ স্রেফ অশিক্ষার কারনে, গুজবের প্রভাবে এই যোদ্ধাদের বলা হচ্ছে, ‘বাড়ি ছেড়ে দিন, পাড়া ছেড়ে দিন’৷ লকডাউন পরিস্থিতির মধ্যে এরা কোথায় যাবেন? কেন তাদের এসব কথা শুনতে হবে? যারা আজ সমাজবিরোধীদের সুরে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের হুমকি দিচ্ছেন, তারা অসুস্থ হলে কার কাছে যাবেন ? শুধু বাড়ি ছাড়ার হুমকিই নয়, বিচিত্র সব ‘ফতোয়া’-র মুখেও আজ পড়তে হচ্ছে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদের৷ সামাজিক বয়কটের মুখেও পড়ছেন তাঁরা৷ সল্টলেকের যে বেসরকারি হাসপাতালে রাজ্যের প্রথম করোনা আক্রান্তের মৃত্যু হয়েছে, সেখানকার সর্বস্তরের কর্মীরা তো এখন সামাজিকভাবে বিপন্ন৷ এমনকী এক বাবা সেখানে চাকরি করায় মেয়েকে টিউশনে আসতে পর্যন্ত নিষেধ করার অভিযোগও উঠে এসেছে। সংবাদমাধ্যমের কাছে আর জি কর হাসপাতালের এক নার্স উদ্বেগের সঙ্গেই বলেছেন, ‘‘করোনা আইসোলেশন ওয়ার্ডে ডিউটি করিনা৷ সেবার ধর্মে সে কাজ করতে হলেও অস্বীকারের সুযোগ নেই। কিন্তু বাড়িওয়ালার হুমকি শুনছি, বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার জন্য”৷ এমনই অভিজ্ঞতার কথা ফেসবুকে লিখেছেন, বেলেঘাটা আইডি-র এক নার্স। লিখেছেন,”বুঝতে পারছি মানুষ কত স্বার্থপর!’’ বহরমপুর মেডিক্যাল কলেজের এক চিকিৎসক প্রতিবেশীদের অত্যাচারে ভাড়াবাড়ি ছেড়ে হাসপাতালের কোয়ার্টার্সে৷ তাঁর প্রশ্ন, ‘‘অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে। সাধারণ মানুষ সেই লড়াইয়ে পাশে থাকবেন, এটুকুও চাইতে পারবো না ?’’
দিনভর ‘জনতা কার্ফু’ পালন করার পর আমরা স্বাস্থ্যযোদ্ধাদের
ধন্যবাদ জানাতে সেদিন সোৎসাহে ঘন্টা নেড়েছি৷ সেই ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলে লাইক-কমেন্ট খেয়েছি৷ আর আজ আমাদের মধ্যেই থাকা কিছু মানুষের অ-সামাজিক কার্যকলাপে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীরা আতঙ্কিত৷ কে জানে সেদিন হয়তো প্রধানমন্ত্রীর ডাকে এরাও সাড়া দিয়ে চিকিৎসকদের অভিবাদন জানিয়েছিলেন৷ আজ মুখ থেকে সরে গিয়েছে মুখোশটা৷ এখনও আমরা চুপ থাকবো ?

আমাদের সুস্থ রাখতে এই ঘোর বিপদের দিনেও কর্তব্য থেকে একচুলও সরে আসেননি চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা৷ মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে টানা ২৪ ঘন্টা অক্লান্ত পরিশ্রম চালিয়ে যাচ্ছেন ওনারা৷ আর সমাজের একটি অংশের মানুষের অনভিপ্রেত আচরণ তাঁদের মনোবলে ক্রমাগত আঘাত করেই চলেছে। আমরাই আজ প্রশ্ন তুলে দিয়েছি, করোনা’র সঙ্গে যারা অসম যুদ্ধ লড়ছেন, পাশবিক চাপে তারা ঘরে বসে গেলে সমাজ কি রক্ষা পাবে ? সমাজকেই আজ সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা কী চায়? এক শ্রেণির মানুষের এমন আচরণের বিরুদ্ধে আমাদের
কঠোর অবস্থানই সমাজকে বাঁচাতে পারে৷ কিছু মানুষের এই এই সামাজিক অসভ্যতা বন্ধ করতে হবে আমাদেরই৷ নাহলে ঘণ্টা বাজানোর সেই জাতীয় কর্মসূচি আজ আত্মঘাতী হয়ে উঠবেই৷ আসলে কোথায় থামতে হয়, এই পরিমিতিবোধ আমাদের খুবই কম। কোনও মন্দির- মসজিদ- গির্জার সাধ্য নেই এই আতঙ্কের সঙ্গে যুদ্ধ করার, কোনও দেবদেবী নয়, মৃৃত্যুদূতের সামনে দাঁড়িয়ে বুক চিতিয়ে যারা লড়ছেন, সেই চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে যারা ক্ষমাহীন ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করছেন, তাদের রুখতে হবে আমাদেরই, তাদের বিচারও করতে হবে আমাদের৷

আজ সময় এসেছে, যাদের জন্য সেদিন ঘন্টা বাজিয়েছি তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর৷ আমাদেরই আজ ঠিক করতে হবে, আমরা কী চাই৷ এখনও যদি কিছু অমানুষের হাত থেকে এই যোদ্ধাদের রক্ষা করতে না পারি, এই যোদ্ধাদের মনোবল দুর্বল হয়ে যাবেই৷ মাথায় রাখতে হবে, শুধুই মহাজাগতিক কম্পাঙ্ক তৈরি করে বা বাহ্যিক ‘ধামাকা’-র সহযোগিতায় করোনা-নিধন হবে না৷ কম্পাঙ্ক তৈরি করার জন্য সেদিন একটি হাত খুঁজে পেতে হলেও আজ প্রয়োজন এই চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদেরই, আজ যাদের একাংশের সঙ্গে আমরা সঠিক ব্যবহার করছিনা৷ এই অসভ্যতা বন্ধ করতে প্রশাসন তো সক্রিয় হবেই, কিন্তু এক্ষেত্রে নাগরিকদের ভূমিকাও তো কিছু থাকে৷
আমাদের আজ বোঝাতেই হবে, এই যোদ্ধাদের পাশে আছি আমরাও৷ সরব হোন, সক্রিয় হোন, রুখে দিন এই অনাচার৷