পানিহাটি পুরসভা ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কামারপাড়া। সেখানেই থাকতেন আরতী দাস। নিতান্ত সাধারণ ভাবে। কিছুদিন এলাকায় নাচের ক্লাস চালিয়েছেন। পরে বয়েসের ভারে তাও বন্ধ। বৃহস্পতিবার, সকালে নিজের বাড়িতেই মৃত্যু হয় ছিয়াত্তর বছরের এই মহিলার। দীর্ঘদিন ধরেই ভুগছিলেন কিডনির সমস্যায়। এই বৃদ্ধার স্বাভাবিক মৃত্যুও সব সংবাদ মাধ্যমের হেডলাইন। কারণ, তিনিই ছিলেন ছয়ের দশক থেকে কলকাতার রাতপরী। পার্কস্ট্রিট, ধর্মতলা চত্বরের অভিজাত হোটেল, ক্লাবের চুঁইয়ে পড়ে মায়াবি আলো পিছলে যেত তাঁর শরীরে। একবার তার সাথে একলা হতে চাইতেন সেসময়ের তাবড় পুরুষেরা। সাদা চামড়ার মেমসাহেব ক্যাবেরা ডান্সারদের মধ্যে আলাদা করে নজর টানতেন মিস শেফালি।
পূর্ববঙ্গ থেকে দেশভাগে ক্ষত গায়ে নিয়ে মায়ের হাত ধরে আরও ভাইবোনদের সঙ্গে এদেশে আসা। শুরু কঠিন সংগ্রাম। নাচতে ভালবাসতেন। কিন্তু পেটের ভাতই জুটত না, তায় আবার নাচ শেখা। লেখাপড়াও হয়নি প্রথা মতো। এই পরিস্থিতি এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবারে কাজ জোটে। পর্দার ফাঁকে চোখ রেখে দেখতেন সাহেব-মেমদের ডান্স। আর তাঁরা বাড়ির বাইরে গেলেই গান চালিয়ে সেই নাচ প্র্যাকটিস করতেন। এইভাবেই শুরু।
সেখানেই আলাপ একজনের সঙ্গে। সেই যুবককে মনে ধরেছিল শেফালি থুড়ি আরতির। তাঁকে বলেন একটি ভালো কাজ দিতে। তিনিই সন্ধান দেন হোটেলে নাচের। যাত্রা শুরু। প্রথম কাজের সুযোগ আসে ফার্পোয়। সেই সময় মাইনে ছিল ৭০০ টাকা। আর ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর হোটেল, ক্লাবে ডাক আসে। আর গুণমুগ্ধর তালিকায় কে নেই? স্বয়ং বিগ বি থেকে উত্তম কুমার। আলাপ ছিল সেই সময়কার সব তাবড় বলিউডের নায়কদের সঙ্গে।
এরকমই এক হোটেলের ডান্স ফ্লোরে মিস শেফালি চোখে পড়েন সত্যজিৎ রায়। সুযোগ পান তাঁর দুটি ছবি সীমাবদ্ধ ও প্রতিদ্বন্দ্বী-তে। আরও বেশ কয়েকটি সিনেমাতেও দেখা যায় শেফালিতে। এছাড়া, পেশাদার মঞ্চেও দেখা যায় তাঁকে। বিশ্বরূপায় তাঁর থিয়েটার বিতর্কের ঝড় তুলেছিল। অশ্লীলতার অভিযোগে রীতিমতো বিক্ষোভ দেখানো হয় হলের সমানে।
তবে, “দেহ পট সনে নট, সকলই হারায়”। সেই মতো বয়সের ভারে ধীরে ধীরে সরে যেতে হয় তাঁকে। ভিড়ে মিশে একদিন মিস শেফালি হয়ে ওঠা আরতি আবার ফিরে যান পুরনো নামে। ঠাঁই হয় ছোট্ট একটি ফ্ল্যাটে। কারণ, জীবনে দেশি-বিদেশি প্রচুর গুণমুগ্ধ এলেও, ঘর বাধা হয়নি। রাতপরীকে দিনের আলোয় মনেও রাখেনি কেউ। হয়ত কখনও জুগেছে নামমাত্র সংবর্ধনা। তার বেশি কোনও স্বীকৃতি পাননি শেফালি। অভিনেত্রী তো দূর, নৃত্যশিল্পী হিসেবেও কেউ সম্মান দেয়নি তাঁকে। এক সময়েই মঞ্চ কাঁপানো ক্যাবারে ডান্সারকেই মেন রেখেছে সবাই। তাই শেষদিনেই নিতান্ত অনাড়ম্বর ভাবে চলে গেলেন তিনি। চেনা পরিচিত ও আত্মীয়দের চোখের জলেই শেষকৃত্য হয় পানিহাটির শ্মশানে। মুখাগ্নি করেন ভাইপো ও ভাইঝি । আবসান হয় একটি যুগের।
Sign in
Welcome! Log into your account
Forgot your password? Get help
Password recovery
Recover your password
A password will be e-mailed to you.