দলের শীর্ষস্তর থেকে ধারাবাহিকভাবেই অপ্রয়োজনীয়, বিতর্কিত, অশোভনীয় কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছিলো বঙ্গ-বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষকে৷ কিন্তু কারো কোনও কথাই কানে নেননি দিলীপ ঘোষ৷ এমন সব কথা প্রতিদিন
বলেছেন যাতে অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়ছে দল৷ রাজ্য বিজেপির নেতাদের কাছেও দিলীপ ঘোষের এ ধরনের বক্তব্য কার্যত অসহ্য হয়ে উঠেছে৷
কিন্তু বিষয়টি ক্রমেই সিরিয়াস হচ্ছে এই কারনেই যে, দিলীপ ঘোষের বে-লাগাম কথার জেরে বিরোধী দলগুলি সমানে তোপ দেগে চলেছে বিজেপির উদ্দেশ্যে ৷ সব কিছুই হজম করতে হচ্ছে গেরুয়া শিবিরকে৷ তবুও দিল্লির নেতারা কড়া পদক্ষেপের কথা ভাবেননি৷
কিন্তু রবিবার দিলীপ ঘোষ সব সীমা অতিক্রম করে এমন কু-বাক্য বলেছেন যাতে শুধুই বঙ্গ-বিজেপি নয়, একইসঙ্গে দিলীপ ঘোষ ধ্বংস করেছেন বিজেপি নিয়ন্ত্রিত অসম, কর্ণাটক, উত্তর প্রদেশ সরকারের ভাবমূর্তিও৷ দিলীপবাবু রবিবার এক সভায় বলেন, ” যারা নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে, সম্পত্তি নষ্ট করছে, সেই সব শয়তানদের অসম, কর্ণাটক, উত্তর প্রদেশ সরকার গুলি করে মেরেছে৷ কিন্তু এ রাজ্যে কাউকে গ্রেফতারই করা হয়নি”৷ দিলীপবাবু আরও বলেছেন, “এখানে আসবে, থাকবে,খাবে৷ আবার সরকারি সম্পত্তির ক্ষতি করবেন আমরা এলে লাঠি মারবো, গুলি করবো,জেলে পাঠাবো”৷
বঙ্গ-বিজেপির সভাপতি তথা সাংসদ দিলীপ ঘোষের সর্বশেষ “মধুর ভাষন” তিন রাজ্যের বিজেপি সরকারকেই “ট্রিগার-হ্যাপি” বানিয়ে ছেড়েছে৷ তাঁর বক্তব্য বিজেপির এমন ভাবমূর্তি গড়ে দিয়েছে, যা শুনে সাধারন মানুষের ধারনা হচ্ছে, বিজেপি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে গুলি চালাতে অভ্যস্ত৷
এইখানেই দিলীপ ঘোষের সস্তায় প্রচারের আলোয় থাকার ছক ধাক্কা খেয়ে গিয়েছে৷ দলের হাই-কম্যাণ্ড একদমই এই কথা সহ্য করেনি৷ তাই সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি নির্দেশেই কেন্দ্রীয়মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় ট্যুইট করে বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষকে তুমুল ঝেড়েছেন৷
রবিবারের দিলীপ ঘোষের মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে বাবুল সুপ্রিয় সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, “দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো কথা বলেছেন দিলীপ ঘোষ”। বিরোধী নেতাদের সম্পর্কে এতদিন বাবুল যে সব কথা বলেছেন, ঠিক সেইসব কথাই এদিন শুনিয়েছেন দিলীপ ঘোষকে৷ বাবুলের এহেন ট্যুইট-তোপ দেখে বিরোধীরা তো বটেই, বঙ্গ-বিজেপিও যারপরনাই বিস্মিত হয়েছে৷ প্রথমে দলের একাংশের তরফে বলা হচ্ছিলো, বাবুল এ ধরনের বিবৃতি দিয়ে দলের শৃঙ্খলা ভেঙ্গেছেন৷ কিন্তু যে মুহুর্তে জানা গিয়েছে, বাবুল সুপ্রিয় এই বিবৃতি দিয়েছেন দলের শীর্ষ স্তরের নির্দেশে, সেই মুহুর্তেই সবাই ‘পাল্টি’ খেয়ে বাবুলের বক্তব্যকেই জোর গলায় সমর্থন করা শুরু করে দিয়েছেন৷
তাই এটা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে, বিজেপির রাজ্য সভাপতি পদে দিলীপ ঘোষের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন বিজেপির শীর্ষ নেতারা। এ রাজ্যের দলীয় সাংসদরাও বিরক্ত হয়ে উঠেছেন দিলীপের টানা কুকথায়৷
বঙ্গ-বিজেপির পরবর্তী সভাপতি হিসাবে দিলীপ ঘোষের নাম ঘোষনা সময়ের অপেক্ষা বলেই দলের অভ্যন্তরের খবর৷ কিন্তু সোমবার থেকে এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি জোরালো হয়েছে৷
গেরুয়া-শিবিরের অভ্যন্তরে জোরালো দাবি উঠে গিয়েছে, দিলীপ আর নয়, নতুন কাউকে বাংলার দায়িত্ব দেওয়া হোক৷ বাবুল সুপ্রিয়র ট্যুইটে ‘অনুপ্রাণিত’ হয়ে রাজ্য বিজেপির বড় নেতাদের সিংহভাগ এদিন থেকেই “দিলীপ-হঠাও”-এর দাবিতে সরব হয়েছেন৷ বাবুল সুপ্রিয় গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে সেই বিতর্কই উস্কে দিচ্ছেন৷
দিলীপ-বাবুল বিরোধের প্রেক্ষিতে তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এদিন বলেছেন, ” দিলীপ ঘোষের দলের সাংসদই তো প্রকাশ্যে তাঁর বক্তব্য খণ্ডন করছেন। বাংলায় বিজেপিকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য দিলীপ ঘোষের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে গুরুতর সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।”
দিলীপ ঘোষকে নিয়ে দলের অন্দরেই যে প্রশ্ন উঠছে, তা ইতিমধ্যেই বিজেপির শীর্ষ নেতাদের কানে পৌঁছে গিয়েছে। এ রাজ্যে বিজেপির ‘মুখ’ হিসাবে বিজেপি-হাই কম্যাণ্ড ইতিমধ্যেই বাবুল সুপ্রিয়কে ভাবতে শুরু করেছেন সেকারনেই, CAA- পক্ষে বিজেপির বাড়ি বাড়ি যে প্রচার শুরু হয়েছে, সেই প্রচারের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবেই রাখা হয়েছে বাবুল সুপ্রিয়কে৷ দিলীপ ঘোষ রাজ্য সভাপতি হওয়া সত্ত্বেও এই কর্মসূচি উদ্বোধন করার দায়িত্ব দেওয়া হয় বাবুলকেই৷
নিজের “বাক্যচাতুর্যেই” দিলীপ ঘোষ নেতৃত্বের নজর থেকে নিজের নাম কেটে দিতে ‘সফল’ হয়েছেন৷ রাজ্যে ঘুরেও গিয়েছেন অমিত শাহ ঘনিষ্ঠ বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা ভূপেন্দ্র যাদব। যাদব আলাদা আলাদা বৈঠক করে যান রাজ্য নেতাদের সঙ্গে। দিলীপ ঘোষের বদলে এই মুহূর্তে কাকে এরাজ্যে দলের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে সেব্যাপারেও নাকি কথা বলে গিয়েছেন ভূপেন্দ্র যাদব। এই মুহূর্তে বিজেপির রাজ্য সভাপতির পদ নিয়ে নতুন জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে। রাজ্য সভাপতি পদে দিলীপ ঘোষই থাকবেন নাকি তাঁর বদলে দায়িত্ব আসছেন অন্য কেউ, সেই প্রশ্নেই ফের তোলপাড় বঙ্গ-বিজেপির অন্দর৷
সূত্রের খবর, দিলীপ ঘোষের কাছে দলের হাই-কম্যাণ্ডের জরুরি এক বার্তাও নাকি পৌঁছে গিয়েছে৷ যাতে না’কি বলা হয়েছে, কু-বাক্য বলে দলের ভাবমূর্তির আর কখনই বারোটা বাজানোর চেষ্টাই করবেন না, এমন মুচলেকা দিলে, ফের তাঁর নাম সভাপতি পদে বিবেচনা করা যেতে পারে৷
কাঠগড়ায় দাঁড়ানো দিলীপ ঘোষ সম্পর্কে শীর্ষ-গেরুয়া মহল কোন পথে হাঁটে, সেটাই এখন দেখার৷