
দুটিই অরাজনৈতিক সভা। বলা উচিত সরকারি সভা। বক্তা প্রধানমন্ত্রী। রাজনৈতিক আক্রমণ বিরোধীদের। প্রশ্ন সে নিয়েই।
স্বামীজির স্মৃতি বিজড়িত বেলুড়ে রবিবার সকালে ছিল যুব দিবস। উপলক্ষ্য স্বামী বিবেকানন্দের ১৫৭তম জন্মদিবস। বক্তা প্রধানমন্ত্রী। দর্শক অধিকাংশ পড়ুয়া। মঞ্চে সন্ন্যাসীরা। সেই মঞ্চে নাগরিকত্ব আইনের প্রসঙ্গ তুললেন প্রধানমন্ত্রী। শুধু তুললেন তাই নয়, বিরোধীদের আক্রমণ করতে গিয়ে বললেন, এই আইন নিয়ে কিছু রাজনৈতিক দল রাজনীতি করছে। ছাত্রদের ভুল বোঝাচ্ছে। আমাদেরও বোঝাতে হবে। আপনারা যেটা বুঝছেন সেটা ওরা বুঝছেন না! তাহলেই বুঝতে পারছেন, কার উদ্দেশ্য কী!
প্রশ্ন এক : বেলুড় মঠ একটি অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। সেখানে দলীয় রাজনীতির কথা বলা, কিংবা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিকে আক্রমণ করা কতখানি শোভনীয় এবং যথাযথ?
প্রশ্ন দুই : বেলুড় মঠের যে সন্ন্যাসীরা নিজেদের অরাজনৈতিক বলেন, তাঁরা কেন এ বিষয়ে একটি মন্তব্যও করলেন না। যাঁরা স্বামীজি, শ্রীরামকৃষ্ণ এবং সারদা মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এসে এই পবিত্র স্থানকে সর্বোচ্চ আসন দেন, তাঁদের প্রতি বেলুড় মঠ পরিচালন সমিতি কি যথাযথ সুবিচার করলেন?
প্রশ্ন তিন : বেলুড় মঠে কোনওদিন ‘ভারত মাতা কি জয়’ স্লোগান ওঠেনি। স্বয়ং স্বামীজি মোটেই এই ধরণের কোনও স্লোগান দিতেন বলে ইতিহাসের পাতা থেকে কেউ খুঁজে পাবেন না। তাহলে প্রধানমন্ত্রী দলীয় সভার স্লোগান কেন বেলুড় মঠে স্বামীজির স্মৃতি বিজড়িত জায়গায় তুললেন?এসব স্লোগান দেওয়ার জন্য তো দলীয় সভা রয়েইছে। সেখানে হতে পারত! অবাক লেগেছে সেই সব সন্ন্যাসীদের আচরণে, যাঁরা প্রধানমন্ত্রীকে এই সুযোগ করে দিলেন। যদি তাঁদের অজান্তেই এটা হয়ে থাকে তাহলে তাঁদের অন্তত আন্তরিক দুঃখপ্রকাশ তো স্বামীজি ভক্তরা আশা করতেই পারেন। কাল যদি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বেলুড়ের কোনও অনুষ্ঠানে গিয়ে এনআরসি-সিএএ বিরোধী কোনও সভা করতে চান, তাহলে তার অনুমতি মিলবে তো!
প্রশ্ন চার : বিরোধীদের আক্রমণ করতে গেলে খোলা ময়দানে জনসভা করুন না। সরকারি সভাকে কেন দলীয় সভায় রূপান্তরিত করলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী?
এরপর পোর্ট ট্রাস্টের সভা। কেন্দ্রের অধীনে বন্দর। কেন্দ্রের একশোবার অধিকার আছে নাম বদলের। করেওছেন প্রধানমন্ত্রী। এটাও আদ্যপান্ত সরকারি সভা। সেখানে কেন্দ্রের আয়ুষ্মান ভারত যোজনা নিয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছেন আমরা সরাসরি টাকা দিই মানুষকে। এখানে তা হয় না। নাহলে কাটমানি, সিন্ডিকেট চলবে কী করে! মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এ নিয়ে আপনার অভিযোগ থাকতেই পারে। কিন্তু সরকারি সভায় এ কথা বলা মানায়? মুখ্যমন্ত্রী যদি আপনার অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেন, তাহলে এ কথা বলতে পারতেন? রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সরকারি সভাকে দলীয় সভায় পর্যবসিত করছেন বলে আপনারাই এক সময় অভিযোগ তুলেছেন। তাহলে আজ প্রধানমন্ত্রী আপনি তো সেই একই কাজ করলেন। এমন বিষয়ের উত্থাপন করলেন, যে বিষয়টা কলকাতা বন্দরের ১৫০বছর পূর্তিতে মোটেই শোভনীয় নয়, যায় না। এবং একজন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মোটেই মানানসই নয়।
প্রশ্ন দুই : মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি যে পথ দেখিয়ে গেলেন, সেই সুর ধরে ধরা যাক এমন একটি সভা হল, যেখানে বিদেশি অতিথিরাও রয়েছেন, সেখানে যদি ব্যবসা-বানিজ্য সংস্কৃতির কথা বলতে গিয়ে গুজরাত প্রসঙ্গ ওঠে এবং কেউ যদি ফস করে বলে বসেন, ওখানে ব্যবসা করার আগে পাঁচবার ভাববেন। কারণ, এই সেই গুজরাত, যেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। এবং যখন হয়েছিল, যিনি মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তিনিই এখন প্রধানমন্ত্রী। হ্যাঁ, অত্যন্ত অনৈতিক কথা। কিন্তু বাস্তব সত্য কথা বলেছেন। তখন আশা করি তারস্বরে আপনার সহকর্মীরা রাস্তায় নেমে পড়বেন না। কারণ এই রীতি-রেওয়াজ তো আপনারই দেখানো পথ!
আসলে বিরোধীদের দুষতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বুঝিয়ে দিয়েছেন, বাংলার বিরোধিতায় তিনি বেশ অস্বস্তিতে। তাই স্থান-কাল-পাত্র ভুলে যেটুকু সুযোগ পেয়েছেন তার সদব্যবহার করে গিয়েছেন। তাহলে যে কাজ নিজে করছেন, সেই একই কাজের অভিযোগ কেন অন্যদের বিরুদ্ধে তুলছেন?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বাংলায় একটা কথা আছে, কারওর দিকে তর্জনী তুললে মাথায় রেখো নিজের দিকে তিনটি আঙুল নির্দেশিত থাকে। আর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ থাকে আকাশের দিকে। যদি আপনাদের কথায় মহাবিশ্বে ঈশ্বরের উপস্থিতির কথা মেনে নিতে হয়, তাহলে এই চার আঙুলের দিকে কিন্তু পঞ্চম আঙুল তথা ঈশ্বর সব সময় নজর রাখছেন।
বিঃ দ্রঃ — কোনও সিরিয়াস বিষয় নিয়ে বাবুল সুপ্রিয়র মতো সহকর্মীকে বক্তব্য রাখতে না পাঠানোই ভাল। এতে আর যাই হোক আপনাদের কোনও উপকার হচ্ছে না। কী হচ্ছে তা একটু কান পাতলেই বুঝতে পারবেন!