
পুরোটাই স্ক্রিপ্টেড৷
নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে দেশজুড়ে চলা ধারাবাহিক আন্দোলনে কার্যত দিশাহারা কেন্দ্র৷ ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর এই প্রথমবার এমন সর্বাত্মক এক নাগরিক- আন্দোলনের মুখে নরেন্দ্র মোদি৷ গোটা দেশ নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে এভাবে একসুরে কথা বলবে, তা ধারনারও বাইরে ছিলো বিজেপি’র, কেন্দ্রের৷ এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্র যতই স্মার্টনেস দেখানোর চেষ্টা করুক, আসলে গণ-আন্দোলনের জোয়ারে কার্যত কুঁকড়েই যাচ্ছে বিজেপি তথা বিজেপি’র সরকার৷ বিরোধী রাজ্যগুলিতে আন্দোলন হবেই, এমন মানসিক প্রস্তুতি বিজেপি আগেই তৈরি রেখেছিলেন৷ কিন্তু গেরুয়া-রাজ্য,অসম, ত্রিপুরা বা উত্তরপ্রদেশ যে এভাবে বে-হাল হবে, তা অঙ্কের বাইরে ছিলো৷
মোদিজি কিন্তু আগে থেকেই নিজের ‘জমি’ তৈরি রেখেছিলেন৷ নাগরিকত্ব বিল সংসদে পেশ করার সময় থেকেই নিজেকে নিজেই ‘ব্যাক বেঞ্চে’ নিয়ে যান৷ গোটা দেশের কাছে এমন একটা বার্তা দেন, যেন এই নাগরিকত্ব বিল-টা শুধুই অমিত শাহের৷ অমিত শাহ-ই এই আইনের অভিভাবক৷ মোদি এ খেলায় এতটাই ‘রক্ষণাত্মক’ ছিলেন যে সংসদে CAA-র পক্ষে ভোট পর্যন্ত দেননি৷
এদিকে CAA-র প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে দেশ৷ তখনও মোদি নীরব৷ কানাঘুঘো কথা শুরু হয়, হচ্ছেটা কী? পুরোটাই যে স্ক্রিপ্টেড, তখনও তা ধরা যায়নি৷
ওদিকে একের পর এক হুংকার দিয়ে অমিত শাহ কার্যত দেশবাসীর কাছে ভিলেন হয়ে উঠেছেন৷ শাহ মুখ খুললেই আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ ঝাড়খণ্ডে ভোট প্রচারে গিয়ে অমিত শাহ হুঙ্কার দিলেন, পরবর্তী লোকসভা ভোট ২০২৪ সালে, তার আগেই দেশজুড়ে সম্পন্ন হবে NRC- প্রক্রিয়া ৷ সব অবৈধ অভিবাসী তথা অনুপ্রবেশকারীদের ২০২৪-র আগেই দেশছাড়া করা হবে৷ আগুনে ঘি ঢাললেন শাহ৷ আরও তীব্র হলো নাগরিক আন্দোলন৷
মোদি তখনও নীরব৷ রাজনৈতিক মহল ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করলো, তাহলে কি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা অর সুখের সংসার নয়? বিজেপির এক এবং দু’নম্বর নেতার সম্পর্কে কি চিড় ধরছে ? মোদি কি শাহের হাতের পুতুল হয়ে পড়েছেন? ওদিকে একের পর এক রাজ্যে বাড়ছে আন্দোলনের তেজ৷ শাহের কোনও বার্তাই কাজে লাগছে না৷
সেই সময় মঞ্চে এলেন মহামহিম নরেন্দ্র মোদি! এসেই দেশের সবধরনের সংবাদমাধ্যমে বিশাল সাইজের বিজ্ঞাপন দিয়ে অমিত শাহের NRC- সংক্রান্ত যাবতীয় দাবি নস্যাৎ করে দিলেন৷ বিজ্ঞাপনে বলা হলো, “এখনও দেশ জুড়ে NRC-র ঘোষণা হয়নি৷ যদি হয়,তা হলে সেই পরিস্থিতিতে নিয়ম ও নির্দেশিকা এমন ভাবে তৈরি করা হবে যাতে কোনও ভারতীয় নাগরিক অসুবিধায় না পড়েন।” সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন উঠলো, তাহলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী না প্রধানমন্ত্রী অনুমোদিত কেন্দ্রের বিজ্ঞাপন, কে ঠিক? কোনটা ঠিক? প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আরও একধাপ এগিয়ে স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী জি কিষেণ রেড্ডি বিজ্ঞাপনের বক্তব্য সমর্থন করে বলে দিলেন, “NRC নিয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকই হয়নি৷ বিষয়টি কবে হবে কেউ জানে না”।
অমিত শাহ তো যে সে নাগরিক নন৷ তিনি দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৷ তাঁর বক্তব্যের ওজন আছে৷ অথচ তাঁর অধীনস্থ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী উড়িয়ে দিলেন শাহের কথা, এটা স্বাভাবিক হতে পারে না৷ একইসঙ্গে কৌতূহল বাড়লো, সরকারের অভ্যন্তরে কী এমন ঘটনা ঘটে গেলো যে ভারত সরকার দেশের প্রায় সব সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে অমিত শাহের বক্তব্য উড়িয়ে জানাচ্ছে NRC নিয়ে কোনও ঘোষণাই হয়নি৷
ততদিনে দেশব্যাপী চলা CAA-বিরোধী বিক্ষোভে বেকায়দায় মোদি। দেশের মুসলিমদের মধ্যে একটা আতঙ্ক তো হচ্ছেই৷ কিন্তু একইসঙ্গে দেখা যাচ্ছে, হিন্দুদের মধ্যেও এই NRC-CAA নিয়ে উদ্বেগ-আতঙ্ক একটুও কম নয়৷ অসমের NRC-তে মোট ১৭ লক্ষ নাম বাদ গিয়েছে৷ তার মধ্যে ১২ লক্ষ’ই হিন্দু৷ সেই ঘটনা এবার যে দেশজুড়ে ঘটবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায় ? ফলে, কেন্দ্র যতই হিন্দুদের “আশ্বস্ত” করুক, অসমের পর সে কথা আর কেউই বিশ্বাস করছে না৷
এর পরই ঠাণ্ডা মাথায় ছক কষে বাজারে ‘রোমাঞ্চকর’ জল্পনা খাওয়ানোর খেলায় নেমেছেন স্বয়ং নরেন্দ্র মোদি৷ একটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছেন, যেন NRC – CAA ইস্যুতে মোদির সঙ্গে শাহের “মতবিরোধ” হচ্ছে৷ এতে পুরোটাই লাভ গেরুয়া শিবিরের৷ বিরোধীরা মজা পাবে “আমরা জয়ী” ভেবে৷ শাহের উপর বীতশ্রদ্ধ বিক্ষোভকারীরা মোদির উপর ভরসা করবেন৷ আন্দোলন স্তিমিত হবে৷ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে৷
এই ছকেই এবার খাওয়ানো হচ্ছে যে NRC – CAA জট খুলতে উদ্যোগী হচ্ছেন স্বয়ং মোদি, শাহকে বাইরে রেখে৷
এর পরই প্রকাশিত হয়েছে ১৩টি প্রশ্ন সম্বলিত নথি৷ দেশব্যাপী চলা CAA- বিরোধী আন্দোলনের মাঝে কেন্দ্রের এই উদ্যোগ তাৎপর্যপূর্ণ৷ বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এই নথির সারাংশ, ”বিপথে যাবেন না। ভুল তথ্যে প্রভাবিত হবেন না।” কেন্দ্রের এই নথি ভারতীয় মুসলিমদের আশঙ্কাও দূর করবে বলে দাবি করা হচ্ছে। এবং সবটাই মোদিজির নির্দেশে হচ্ছে৷ এখানে শাহ নেই৷
কিন্তু এমন ভাবার কোনও কারন নেই যে মোদি – শাহের মিত্রতায় ফাটল লেগেছে৷ সবটাই সাজানো৷ গোটাটাই স্ক্রিপ্টেড৷ মোদি-সাহেব বিজ্ঞাপন দিয়ে গ্যারাজ করলেন শাহকে, দেশবাসী যদি এমনটা ভেবেই ভরসা করেন মোদিকে, আখেরে লাভ তো কেন্দ্রেরই৷
আরও পড়ুন-শহরজুড়ে রমরমা “জাম্বো” পেঁয়াজের! কোথা থেকে এল জানেন?