“ওরা বলল নেমে যান, ট্রেনটা জ্বালিয়ে দেব”

0
10

( উলুবেড়িয়ায় সিএএ বিরোধী বিক্ষোভে ট্রেনে হামলার সময় সেই ট্রেনেই ছিলেন যুবনেতা সজল ঘোষ। ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা জানাচ্ছেন তিনি নিজেই)

#NRC_CAB

অনেকদিন চেষ্টা করে ছোটবেলার থেকে শুরু করে আজকের যারা আমাদের থেকে ছোট সবাইকে একজোট করে, আমরা প্রায় জনা পঞ্চাশেক বেরিয়ে পড়েছিলাম দীঘার উদ্দেশ্যে, প্রথম থেকেই প্ল্যান ছিল কোন এসি গাড়ি নয়, কোন এয়ার কন্ডিশন ট্রেন নয়, জীবনের ছোটবেলাটা কে স্মরণ করতে তখন যে রকম ভাবে বাসে করে যেতাম এখন ঠিক সে রকম ভাবে জেনারেল কম্পার্টমেন্টে, ট্রেনে করে যাব।

সেই মতন কান্ডারী এক্সপ্রেস এর টিকিট কাটা হলো, কেন্দ্রীয় সরকার বুলেট ট্রেনের পরিকল্পনা করে কিন্তু হাওড়ায় গিয়ে দেখলাম ভারতীয় রেল যেখানে ছিল সেখানেই আছে, যথারীতি প্রায় মিনিট কুড়ি লেট, যদিও সেটা আমাদের কাছে কোন সমস্যা ছিল না আমাদের তো উদ্দেশ্যই ছিল কিছুটা পিছনের দিকে ফিরে যাওয়ার, হইচই করে জেনারেল কম্পার্টমেন্টে ধাক্কাধাক্কি গুঁতোগুঁতি করে নিজেদের জন্য একটা করে জায়গা দখল করলাম প্রায় প্রত্যেকেই, তারপর থেকে যত ফেরিওলা ভাই উঠেছেন খাবারের আইটেম নিয়ে আমরা কাউকে নিরাশ করিনি, এই অবধি তো সব ঠিকই ছিল।

হঠাৎ……

উলুবেড়িয়া স্টেশনে গাড়িটা থামার কথা ছিল না কিন্তু হঠাৎ থেমে গেল, আমরা তখন গল্প, একে অপরের পিছনে লাগায় মত্ত,দেখলাম আমাদের পাশ দিয়ে একটা তীব্র গতিতে এগিয়ে যাওয়ার ট্রেন হঠাৎ যেন ঝাঁকুনি মেরে দাঁড়িয়ে গেল আর চতুর্দিক থেকে উন্মত্ত মানুষ হাজারে হাজারে, কাতারে কাতারে যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে আর আমাদের দিকে লক্ষ্য করে অজস্র পাথর বৃষ্টি। ঠিক যেমনটা আমরা টিভিতে, ইউটিউবে দেখি কাশ্মীরের বিভিন্ন অঞ্চলে।

কিছু বুঝে ওঠার আগেই চতুর্দিকে পাথরের শব্দ, ট্রেনের ভেতর দু চারজন জনকে আহত হতেও দেখলাম, ট্রেনের ভেতর তখন একটা হাহাকার আর কোনোক্রমে জানলা বন্ধ করার প্রচেষ্টা।

ট্রেনের ভেতরে তখনকার অবস্থা অবর্ণনীয়, মেয়েরা বাচ্চারা তারস্বরে চিৎকার করছে কাঁদছে, কেউ ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছে প্রভু রক্ষা করো, ছোটবেলা থেকেই পাড়ার ডাকাবুকো ছেলেদের দলে আমাদের নাম ছিল, বিশ্বাস করুন এই প্রথম নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগলো।

সারাক্ষণ ধরে চলছে পাথর বৃষ্টি ট্রেনের ভেতর জানলা দরজা বন্ধ করে বসে আছি কোনোক্রমে জানলার ফাঁক করে দেখার চেষ্টা করছি বাহিরে কি হচ্ছে, দেখলাম স্বাধীন ভারতে, এক দল দেশপ্রেমিক, ভারতবর্ষের ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকা কাঁধে নিয়ে স্বাধীনভাবে, যথেচ্ছ ভাঙচুর করছে আশেপাশের ট্রেনগুলোতে, স্টেশনে, ট্রেনের ভেতর থেকে যতটুকু দেখা যাচ্ছিল, কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী, দেখে বুঝতে পারছিলাম কোথাও আগুন ধরানো হয়েছে, সেটা ট্রেনে না রবারের টায়ারের কিছুই বুঝতে পারছি না। একসময় মনে হচ্ছিল আজকে বোধহয় আর বাড়ি ফেরা হবে না, কেউ কেউ আবার সেই সময় গা জালানো গোধরা ঘটনা খেয়াল করিয়ে দিচ্ছিল।

ঘড়ির কাঁটা ততক্ষণে হয়তো ঘণ্টা পার হয়ে গিয়েছে উন্মত্ততা কখন থামবে বুঝতে পারছিনা শুধু বুঝতে পেরেছি NRC আর CAB বিরুদ্ধে নাকি আন্দোলন হচ্ছে, বিশ্বাস করুন জীবনে অনেক ছাত্র আন্দোলন করেছি, সব আন্দোলন ব্যাকরণ মেনে চলেনি, কোন কোন আন্দোলন সংঘাতে, সংঘর্ষে পরিণত হয়েছে কিন্তু তাই বলে নির্বিচারে নিরপরাধ হাজার খানেক মানুষের ওপরে এইভাবে ঘন্টাখানেক ধরে যে তাণ্ডবলীলা চলল সেটা জীবনে কখনো দেখিনি। মজার ঘটনা হল পুরো এক ঘন্টা চলা তান্ডবলীলায় হাতে গোনা পাঁচ থেকে ছয় জন পুলিশকে আমি দেখেছি যাদের মধ্যে একজনকে ওরা চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল আর বাকিদের দেখেছি ছুটে পালাতে, যেভাবে ঠিক দেখেছিলাম কাশ্মীরে।

ঠিক এরকম অবস্থায় মাইকে ভেসে আসতে লাগলো আর এক ভয়ঙ্কর নির্দেশ, যে ট্রেনের যাত্রীদের উদ্দেশ্যে হামলাকারীদের ঘোষণা, তারা যেন এক্ষুনি ট্রেন থেকে নেমে পড়ে এবং পায়ে হেঁটে হাই রোডের দিকে এগিয়ে যায় কারণ যেকোনো মুহূর্তে ট্রেনটাকে জ্বালিয়ে দেওয়া হতে পারে। অগত্যা আর কিছু করার নেই, ঈশ্বরের নাম নিয়ে, ওদের নির্দেশমতো মাথার ওপরে হাত তুলে আর মাথাটাকে সন্ত্রাসের কাছে নুইয়ে দিয়ে, হাই রোডের দিকে এগোতে লাগলাম অন্ধকার পথ ধরে আর চতুর্দিক থেকে অশ্রাব্য গালিগালাজ আমার ধর্ম, আমাদের মাতা পিতা, পিতামহ কে উদ্দেশ্য করে।
যাইহোক ঈশ্বরের অসীম ক্ষমতা শেষ অব্দি আমরা বোম্বে রোডে পৌছালাম সেখান থেকে কোনরকম একটা বাস ভাড়া করে ৫০ জন ছেলে উঠে রওনা দিলাম বাড়ির দিকে।

ভাবছিলাম আমরা কোথায় আছি❓ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম কিংবা জীবনানন্দের বাংলায়❓

হ্যাঁ আমি দৃপ্তকন্ঠে বলি আমি একজন তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মী মমতা ব্যানার্জির আদর্শে দিক্ষিত, আমিও NRC এবং CAB র বিরুদ্ধে, তাই বলে এইযে বীরপুঙ্গব রা আজকে উলবেরিয়া স্টেশনে তাদের তাণ্ডবলীলা চালালেন তাদের সমর্থন করি না।

সরকারের কাছে আবেদন করব আমরা সংখ্যালঘুদের স্বার্থ নিশ্চয়ই সুনিশ্চিত করবো, কিন্তু তাই বলে বাকি সংখ্যাগুরু মানুষকে এইভাবে বিপদের মুখে ঠেলে ফেলে দেওয়া যাবে না। তা নাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ভোটে সিঁদ কাটার চেষ্টা বিজেপি নিশ্চয়ই আবার করবে।

যাইহোক শেষমেষ দিঘা যাওয়া তো হলো না। কোনরকমে প্রাণ নিয়ে বাড়ি এসেছি।
ঈশ্বরকে অজস্র ধন্যবাদ।