সব সংখ্যালঘু এলাকায় একসময়ে বিক্ষোভ কোন সূত্রে বাঁধা? কুণাল ঘোষের কলম

0
4
কুণাল ঘোষ

এন আর সি এবং সি এ বির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হতেই পারে। বিক্ষোভও হতে পারে। জনমতগঠন ও গণআন্দোলন দরকারও বটে।

দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ পাল্টা সরব হবেই।
সংখ্যালঘুরা যদি মনে করেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাঁদের বিপদে ফেলা হচ্ছে, তাহলে পথে নামতেই হবে তাঁদের।

বিক্ষোভের কোনো জাতি, ধর্ম সাধারণত বিচার করা অনুচিত।

কিন্তু শুক্রবার যা হয়েছে, বিশেষত উলুবেড়িয়া বা বেলডাঙার পর, আরও কিছু প্রশ্ন উঠে আসছে।

কোনো একটি এলাকায় স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ হতেই পারে। এটা হয়ত সবটা ভেবেচিন্তে হয় না।

কিন্তু শুক্রবার দেখা গেল উলুবেড়িয়া, পার্ক সার্কাস, বেলডাঙা, রাজারহাটসহ রাজ্যের বিভিন্ন সংখ্যালঘুপ্রধান অঞ্চলে বিক্ষোভ, অবরোধ হয়েছে।

এটা হল কী করে?
এটা কোন্ সূত্রে বাঁধা?
কী করে বিভিন্ন জায়গায় সংখ্যালঘুদের একসঙ্গে পথে নামানো হল?

এর মধ্যে উলুবেড়িয়ার ঘটনা ভয়ঙ্কর। সংগঠিত অথচ নিয়ন্ত্রণহীন জনতা। ট্রেন আক্রমণ করছে। বাইরে থেকে যাত্রীদের পাথর মারছে। অন্ধকারে যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে ট্রেন জ্বালানোর হুমকি দিচ্ছে। স্টেশন ভাঙচুর হচ্ছে।

এসব কী?
পেছনে কারা?

সাধারণ শান্তিপ্রিয় মানুষ যতই আন্দোলন করুন, এই হিংস্রতা হতে পারে?

সেই কলঙ্কিত গোধরায় শুনেছিলাম বাইরে থেকে ট্রেনে আগুন।
এতকাল পরে উলুবেড়িয়ার বুকে ঘটনা ও হুমকি গোধরাকে মনে পড়িয়ে দিল।

এ বড় উদ্বেগের।
এ বড় লজ্জার।

প্রতিবাদের নামে পরিকল্পিত হামলা, যাতে সহনাগরিক বিপন্ন হচ্ছেন, চলতে পারে না।

সরকারি সম্পত্তি নষ্টই শুধু না, যে কোনো বড় অঘটন ঘটতে পারত।

অথচ সেই তান্ডব থামাতে কাউকে দেখা যায় নি ঘটনাস্থলে।

বাংলায় মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেস চড়া সুরে কেন্দ্রীয় আইনের বিরোধিতা করছেন। পথে নামছেন।
বাম বা কংগ্রেস, অন্য দলগুলিও বিজেপির বিরুদ্ধে।
একটা লড়াই তৈরি হচ্ছে।

তার আগেই এই অধৈর্য হিংস্র হামলা কিন্তু নিন্দনীয়।
এতে যা মানুষের প্রতিক্রিয়া, তাতে বিজেপিরই হাত শক্ত হচ্ছে।
যাত্রীবোঝাই ট্রেনের উপর উন্মত্ত জনতার আক্রমণ মানুষ বরদাস্ত করবেন না।

সবচেয়ে বড় কথা, এখানে হিন্দু মানেই বিজেপি নন।
তাহলে মুসলমান সমাজের একাংশ যদি এই ধরণের আগ্রাসী উগ্রতা দেখান, তাতে বিজেপিবিরোধী হিন্দুদেরও উদ্বিগ্ন করে দেওয়া হচ্ছে।

এন আর সি এবং সি এ এ, বিজেপি পরিকল্পিতভাবে এনেছে।
দেশের জরুরি সমস্যা থেকে নজর ঘুরিয়ে আমরা ব্যস্ত এই নিয়ে।
এর মধ্যে বিজেপির ফাঁদে পা দিয়েই যদি সমাজের একাংশ উগ্র হিংসার পথ নেন, তাতে বিপদ তো বাড়তেই থাকবে। এবং এর রাজনৈতিক লাভও যাবে বিজেপির খাতায়।

কেন এই ভুল হবে?

যে বা যারা, রিমোট কন্ট্রোলে শুক্রবার একই দিন একই সময় রাজ্যের বহু এলাকায় সংখ্যালঘুদের পথে নামালেন, তারা দয়া করে সংযত হোন।

একাংশের মিডিয়া ট্রেন বা স্টেশনে আক্রমণের ভয়াবহ দিকটা চেপে গিয়ে শুধু বিক্ষোভ বলে চালালো। এটা আরও ক্ষতিকর। ভয়ানক খারাপটা যথাযথভাবে তুলে না ধরলে প্রশাসন থেকে মানুষ, টনক নড়বে কীভাবে? মানুষকে তো বলতে হবে, প্রতিবাদ হোক। এই অরাজক সন্ত্রাস নয়।

বাংলা জাতিধর্মের রাজনীতি করে না।
কিন্তু তাই বলে বাংলায় ট্রেন আক্রমণের সংস্কৃতিও চলবে না।

বিজেপি ভুল কাজ করছে।
জবাবে আরও বড় ভুল যেন না হয়।

বহু মানুষ বিভ্রান্ত। অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। সংখ্যালঘুদের মধ্যে ধারণা আইনে তাঁদের সুরক্ষা নেই। এর ঠিকভুল জানার পরিস্থিতিও এখনও তৈরি হয় নি। তাঁরা চিন্তায়। এই সন্ধিক্ষণে যাঁরা প্রতিবাদ আন্দোলন করবেন, সেই রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতাদের দেখতে হবে যেন কোথাও কোনো প্ররোচনা তৈরি না হয়ে যায়। এই আগুন রাজনীতির হাতিয়ার হতে পারে না।

সরকার সর্বত্র পুলিশ প্রশাসনকে কড়া হতে বলুন। ট্রেন আটকে তান্ডব চলতে পারে না। ভাঙচুর চলতে পারে না। দীর্ঘ অবরোধ চলতে পারে না।
সরকার তো ইমামভাতা দেন। ইমামদের অনুরোধ করুন প্রতি এলাকায় মানুষকে ধৈর্য রাখার বার্তা দিতে।
সব দলের সব নেতানেত্রীরা দরকার হলে একসঙ্গে যান মানুষকে বোঝাতে।

ট্রেনে হামলার যে কুৎসিত ঘটনা, একজন নেতানেত্রী বা বুদ্ধিজীবীকেও দেখলাম না কড়া ভাষায় নিন্দে করতে।

অথচ বিজেপি বা আরএসএস কর্মীরা যদি একটি বাসে একটি ইঁটও মারত, তা নিয়ে প্রবল হইচই হত। এই আঁতেলরা বোঝেন না তাঁদের এই মেকি ধর্মনিরপেক্ষতার জন্যেই আজ বিজেপির বাড়বাড়ন্ত।

কেন্দ্রীয় আইনের প্রতিবাদ হবে। হোক।
কিন্তু প্রতিবাদের নামে ট্রেন আক্রমণের জঙ্গিপনা মানতে পারব না।

হিন্দু, মুসলমানসহ সব ধর্ম এক হয়ে আইনের শাসনের মধ্যে দাঁড়িয়ে সুষ্ঠু সমাজের মধ্যে দিয়ে কড়া প্রতিবাদ আন্দোলন হতেই পারে।

বিজেপির আইন যদি সম্প্রীতির পক্ষে বিপজ্জনক হয়; তাহলে সম্প্রীতি রক্ষা করেই তার বিরুদ্ধে লড়াইটা জরুরি।